ভিটামিন-ডি হাড়, দাঁত আর মাংসপেশির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবদেহে অনেকগুলো ক্যানসার প্রতিরোধে এর ভূমিকা রয়েছে। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাল্টিপল স্কেলেরোসিসসহ আরও কিছু রোগ প্রতিরোধে এর ভূমিকার কথা শোনা যাচ্ছে। ইনসুলিনের মাত্রা ঠিক রেখে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এটি সাহায্য করে। এ ছাড়া এই ভিটামিন রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনায়, মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। দুই শতাধিক ধরনের জিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এটি। ভিটামিন-ডি শরীরের জন্য খুবই জরুরি উপাদান। দীর্ঘদিন এই ভিটামিনের অভাবে যা হতে পারে- স্থুলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বিষণ্নতা, ফাইব্রোমায়ালজিয়া, হাড় ক্ষয়, ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম, আলঝেইমার্স রোগ ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি এর প্রধান উৎস সূর্যালোক। রৌদ্র-স্নান তাই এত দরকারি। আসুন রৌদ্র-স্নানে। ভিটামিন-ডি বাগিয়ে নিই। এ ছাড়া কিছু ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার তো আছেই। যেমন কলিজা, ডিমের কুসুম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, ছানা, পনির, মাখন, সামুদ্রিক মাছের তেল, সামুদ্রিক মাছ টুনা, স্যামন, ম্যাকারেল, সারডিন, কিছু মাশরুম আর ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ গুঁড়াদুধ, কমলার শরবত ইত্যাদি।
ভিটামিন-ডি শুধু নিরেট ভিটামিন নয় বরং এটিকে বলা যায় হরমোন-প্রাণরস। সুয্যিমামা তার কিরণমালা দিয়ে যখন পরশ বুলায় তখন ত্বকের নিচে তৈরি হয় ভিটামিন ডি-এর প্রাথমিক যৌগ। সাধারণত আমাদের শরীরের শতকরা ৫০-৯০ ভাগ ভিটামিন তৈরি হয় সূর্যালোক থেকেই। সূর্যের আলোকচ্ছটায় থাকে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো। সাধারণত ২৯০-৩১৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি জোগান দেয় ভিটামিন-ডি। এই তরঙ্গের আলোক ঢেউয়ের আরেক নাম আলট্রা ভায়োলেট-বি, বাংলায় এদের নাম দেওয়া হয়েছে অতিবেগুনি রশ্মি-বি। এরা কিন্তু কাচের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে কেউ যদি আয়েশ করে ঘরের ভেতর বসে কাচের জানালার ফাঁক গলে নেমে আসা সূর্য-ঢেউয়ে স্নান সারতে চান তারা কিন্তু বঞ্চিত হবেন এই ভিটামিন থেকে। ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে হবে আলো পেতে অথবা নিদেনপক্ষে কাচের জানালা খুলে দিতে হবে কিংবা আসতে হবে খোলা বারান্দায়। একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে, বাদ্যবাজনা বাজিয়ে ঘটা করে সূর্য-স্নানের জন্য সমুদ্রসৈকতে আরাম কেদারায় শুতে হবে এমনটির দরকার নেই। দরকার শুধু পর্যাপ্ত আলো। তবে এটাও ঠিক সমুদ্রসৈকত নয় বরং পাহাড়ের চূড়ায় ভিটামিন-ডি বরং বেশি।
যারা গৃহবন্দি কিংবা ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে বাইরে বের হন কম কিংবা বেরোলেও একেবারে সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখেন তাদের ভিটামিন ডি -এর ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যারা বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় বৃদ্ধাশ্রমে ঘরের ভেতর অবস্থান করেন তাদেরও একই দশা। বাইরে বের হতে যারা সান-ব্লক ক্রিম ব্যবহার করেন নিয়মিত, কৃষ্ণ ত্বক যাদের প্রকৃতি প্রদত্ত, যারা মুটিয়ে গেছেন কিংবা বুড়িয়ে গেছেন কিংবা খুব সচেতনভাবেই সূর্যালোককে পরিহার করে চলেন তাদের এই ভিটামিনের ঘাটতির আশঙ্কা বেশি। মনে রাখতে হবে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকেই রোদে আসতে হবে ভিটামিন-ডি পেতে। তবে সত্তরোর্ধ্ব বয়সী কুঞ্চিত ত্বক অনেক সময় লাগায় ভিটামিন-ডি তৈরি করতে। সেজন্য আমাদের মুরব্বিদের ভিটামিন-ডির জন্য খানিকটা বেশিক্ষণ রাখতে হবে সূর্য-স্নানে। আর তাদেরই বেশি দরকার এই ভিটামিন।
সূর্য প্রতিদিন অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছে তার কিরণমালা- অঢেল ভিটামিন-ডি অথচ আমরা কি আশ্চর্যজনকভাবে ভুগছি এই ভিটামিনের ঘাটতিতে। প্রায়ই আমরা নানা অজুহাতে আমাদের ছেলেমেয়েদের বারণ করি রোদের ভেতর যেতে। ফলে দেখা যাচ্ছে শহর-গাঁয়ে সর্বত্র অপ্রতুল ভিটামিন-ডি নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম যাদের বেশিরভাগই ভঙ্গুর উনপাঁজুরে হাড় নিয়ে বেড়ে উঠবে আর রোগব্যাধির বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারবে না সামান্য প্রতিরোধ-ব্যূহ যা রীতিমতো জাতীয় স্বাস্থ্যের প্রতি অশনিসংকেত। যদিও তারা পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করছে এমনকি রীতিমতো দুধ পানও করছে দুবেলা। এ যেন সুলিভানের সেই কথার মতো যিনি তার গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক আমেরিকান কিশোরীর ভিটামিন-ডির ঘাটতি দেখে, যারা সবাই ছিল সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, প্রাণোচ্ছল আর পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণকারী। কিন্তু ছিল ভিটামিন-ডি ঘাটতির শিকার। আর বৃদ্ধবনিতা তো রয়েছেনই ঘাটতির ভেতর। সুতরাং নিজেসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সূর্য-স্নান করুন, উৎসাহিত করুন রৌদ্রের কাছে যেতে, প্রকৃতির কাছে যেতে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
ক্লাসিফাইড মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, সিএমএইচ, ঢাকা