বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রথম রেপার্টরী নাট্য প্রযোজনা ‘টার্গেট প্লাটুন’ এর প্রিমিয়ার শো আগমী ২৭ জুলাই সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমীর অর্থায়নে নির্মিত এই নাটকটির রচনা ও নির্দেশনার কাজটি করছেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। আর এই নাটকের মধ্য দিয়ে আবার গ্রুপ থিয়েটারের কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যাতিক্রমী নাট্য প্রতিভা ড. জামিল আহমেদ। জামিল আহমেদ নাটকের সেট ও লইট ডিজাইন করছেন। ফলে নাটক পাড়ায় টার্গেট প্লাটুন নিয়ে একধরনের কৌতুহল তৈরি হয়েছে। এ প্রজন্মের নাট্যকর্মী ও দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই নাটকটি । তাছারা মামুনুর রশীদ এই প্রথমবারের মতো কোন মিউজিক্যাল নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এই বিষয়টি নাট্যকর্মী ও দর্শকদের মাঝে একধরনের আগ্রহ তৈরি করেছে।
নাটকের প্রিমিয়ার শো করার আগে দীর্ঘ পরিশ্রম করছেন নাটকের কুশীলবরা। গত চার মাস ধরে টানা মহড়া করে যাচ্ছে নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই। নাটকটি দর্র্শকের সামনে মঞ্চায়নের আগে ২৩-২৬ জুলাই একটানা চার দিন টেকনিক্যাল শো করা হচ্ছে। এর আগেও দুটি টেকনিক্যাল শো করা হয়েছে। বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকে এত দীর্ঘ সময় কারিগরী মহড়া করে খুব কম নাটকই মঞ্চে এসেছে। তাই ‘টার্গেট প্লাটুন’ উদ্বোধনী মঞ্চায়ন থেকেই দর্শকের মাঝে ভিন্ন ধরনের সাড়া ফেলবে বলে ধারনা করছেন নাট্যকর্মি ও দর্শক।
বাংলাদেশে পেশাদারী নাট্যচর্চা শুরু করার একধরনের তাগিদ থেকেই শিল্পকলা একাডেমী রেপার্টরী নাট্যদল করে নাটক প্রাযোজনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মঞ্চে আসছে ‘টার্গেট প্লাটুন’, আতাউর রহমানের নির্দেশনায় মঞ্চে আসছে রূদ্র রবী ও জালিওয়ান ওয়ালবাগ এবং লাকী ইনাম নির্দেশনা দিচ্ছেন বীরাঙ্গনাদের দুঃখগাথা নিয়ে নাটক “বিদেহ”।
‘টার্গেট প্লাটুন’ রচনা ও নির্দেশনা প্রসঙ্গে মামুনুর রশীদ বলেন আমাদের লোক আঙ্গিকে গীতল ধারা রয়েছে বহুকালের। একদা আমাদের যাত্রাপালা ও নাটকে সংগীতের ব্যাবহার ছিল ব্যাপক। তারপর প্রসেনিয়াম মঞ্চে সংগীত কালাক্রমে কমে আসে। তার স্থান দখল করে সংলাপ। আবার পালা বদল শুরু হয়েছে বাংলাদেশের নাটকে। এখন গীতল নাট্য-মূল ধারায় জায়গা করে নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা একটু উচ্চাকাংঙ্খি হয়ে একটা পুরো মিউজিক্যাল কাজে নেমেছি। ধারনাটা প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সম্মিলনে একটা ভিন্ন ধরনের কাজ করার প্রচেষ্টা। এ একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। শুধু আমার জন্য না, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সংগীত পরিচালক, কোরিওগ্রাফার, পোষাক পরিকল্পক সবার জন্য। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনাতেও অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশালত্বের প্রয়োজনে মঞ্চের সচরাচার স্থানকে বড় করে নিয়ে তার মধ্যে বিশেষ ধরনের আলোক সম্পাত করার মধ্য দিয়ে এই আয়োজনকে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা। বিষয় বস্তু আমাদের আবেগঘন ইতিহাসের কিছু মুহুর্ত। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, দেশপ্রেমের সেই অপূর্ব দৃশ্যাবলী যেগুলো এখনো আমাদের শিহরিত করে। সেই মুহুর্তগুলোকে এই নাটকে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা হচ্ছে ‘টার্গেট প্লাটুন’।
নাটকের গল্প সংক্ষেপে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জীবনের এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। এই ইতিহাসের সাথে মিশে আছে অসংখ্য আত্ম-ত্যাগের স্মৃতি। এই কাব্যময় রক্তাক্ত ইতিহাসের গীতিময় নাট্যপ্রকাশ ”টার্গেট প্লাটুন”। একজন বাবুর্চি যে যুদ্ধকালীন সময়ে রান্না করেছে, প্রয়োজনে অস্ত্র ধরেছে তাঁর ইতিহাস হয়ত কোথাও লেখা নেই। বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত এক ইঞ্জিনিয়ার যে পাকিস্তানী ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধে তাঁর জীবন বলিদানের গল্প নিছক কল্পনা নয়। একজন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী অথবা একজন কুমার অথবা একজন মূক-বধির, একজন আদিবাসী যুবক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সেই জীবন উৎসর্গের গল্প হয়ত ইতিহাসের কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি। তাই বলে তা কখনোই ইতিহাস বিচ্ছিন্ন কোন গল্প নয়। এমনি হাজারো শ্রেণীর-পেশা-গোত্রের মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে বলেই আমরা এই মানচিত্রের মালিকানা লাভ করেছি।
যুদ্ধ মানেই তো শুধু যুদ্ধ নয়। দেমে দেশে সকল মুক্তির লড়াইয়ে শক্তি সঞ্চার করেছে, প্রেরণা করেছে এমন অনেক মানুষের কথা মহাকাল মনে রাখে নি। সেই সব অজানা গল্প আর অচেনা মানুষের আত্মাহুতির কাহিনী খোঁজে বের করার প্রয়াসই হচ্ছে নাটক ‘টার্গেট প্লাটুন’।
বাদল, ফারুক, কুসুম, পিয়ারু এই নামগুলো হয়ত নাও মিলতে পারে সেই সব নাম না জানা বীরদের সঙ্গে। কিন্তু তাদের সেই আত্মৎসর্গ সত্য বলেই মুক্তি সংগ্রামের সেই বিজয় গাথা নিয়ে আজো আমরা গর্বিত।
এই নাটকে কাজ করছে আরণ্যক, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, প্রাচ্যানাট, প্রাঙ্গনেমোর, তীরন্দাজ, নাটুকে ও থিয়েটার বেইলী রোডের নাট্যকর্মিরা। নাটকের সংগীত পরিকল্পনা করছেন পরিমল মজুমদার।