‘কিং অব পপ’ নামে দুনিয়াজুড়ে পরিচিত লাভ করেছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। তাকে বলা হয় তারকাদের তারকা। খুব বেশি দিনের জীবন না হলেও তিনি রেখে গেছেন অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্পকথা। যা পুরাণিক রূপকথাকেও হার মানায়। বিশ্বের আনাচে-কানাচে রয়েছে তার অসংখ্য-অগণিত শ্রোতা ও ভক্ত-অনুরাগী। বিশ্বব্যাপী এখনো তার গান সমানভাবেই জনপ্রিয়। গানের সাথে নাচের ছন্দে বিশ্ব মাতিয়েছেন এই পপ তারকা।
গোড়ালির ওপর ভর করে অভিকর্ষকে উপেক্ষা করে কীভাবে যে তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে নাচতেন তা এখনো সবার কাছে বিস্ময়! গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল সঙ্গীতশিল্পী তিনি। পপসাম্রাজ্যের এই কিংবদন্তি গান, নাচ ও ফ্যাশনে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে মৃত্যুর পরও মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে বিশ্বময় রয়েছে ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল। তাকে নিয়ে চলছে নানা গবেষণাও। মাইকেল জ্যাকসন একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, গান লেখক, অভিনেতা, সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী। মূলত, তার নাচ ও গানের অসাধারণ শৈলী তাকে বিশ্বের শীর্ষ তারকায় পরিণত করে।
আজ ২৫ জুন পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের চলে যাওয়ার দিন। ২০০৯ সালের এই দিনেই চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো তার জীবনের গতিপথ। তার প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা।
মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গ্যারি নামে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জো জ্যাকসন ও ক্যাথেরিন জ্যাকসন দম্পতির সপ্তম সন্তান। মাইকেলের পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। তার পরিবার ছিল আফ্রো-আমেরিকান।
পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে মাইকেল জ্যাকসনকে কপিকল অপারেটর হিসেবে কারখানায় কাজ করতে হয়েছে। তবে গায়ক হিসেবে জ্যাকসনের উত্থান কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই। তার পাঁচ ভাই ও তিন বোনের সবাই কোনো না কোনো সময় পেশাগতভাবে সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাইকেল জ্যাকসন পেশাদার সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি তখন জ্যাকসন ফাইভ নামের সঙ্গীত গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গান গাইতেন। সেখান থেকেই প্রথম মিউজিক অ্যালবাম ‘ডায়ানা রোজ’ ১৯৬৯ সালে প্রকাশ পায়।
এ অ্যালবামের প্রথম একক গান ‘আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক’ ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে বিলবোর্ডের হট তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমেরিকার পপ সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে মাইকেল জ্যাকসন যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তখন মাত্র ১৩ বছর বয়সে এককভাবে মাইকেল জ্যাকসনের ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়।
১৯৭২ সালে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘বেন’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে তার পরবর্তী অ্যালবাম বের হয়। এ অ্যালবামের নাম ছিল ‘অফ দ্য ওয়াল’। যার ‘ডোন্ট স্টপ টিল ইউ গেট অ্যানাফ’ ও ‘রকিং উইথ ইউ’ গান দুটির মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি। এক দশকের মাথায় জ্যাকসন হয়ে ওঠেন বিশ্বের পপসঙ্গীত শ্রোতাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। শুরু হয় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তারকাখ্যাতির সঙ্গে অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্যে রূপকথার জীবন কাটাতে লাগলেন মাইকেল জ্যাকসন।
গানের তালে তালে মাইকেলের নাচের কৌশলগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এলভিস প্রিসলি পপসঙ্গীতের সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও মাইকেল জ্যাকসনকেই শ্রোতারা গুরু ডাকতে শুরু করে। ১৯৮২ সালে তার ‘থ্রিলার’ অ্যালবামটি সারাবিশ্বে বেস্ট সেলিং অ্যালবাম হিসেবেই ইতিহাস গড়ে। মাইকেলের গাওয়া পাঁচটি সঙ্গীত অ্যালবাম বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত রেকডের্র মধ্যে রয়েছে। সেগুলো হলো- অফ দ্য ওয়াল (১৯৭৯), থ্রিলার (১৯৮২), ব্যাড (১৯৮৭), ডেঞ্জারাস (১৯৯১) ও হিস্টরি (১৯৯৫)।
১৯৮০’র দশকে মাইকেল জ্যাকসন সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী যিনি এমটিভিতে এত জনপ্রিয়তা পান। বলা হয়, তার গাওয়া গানের ভিডিওর মাধ্যমেই এমটিভির প্রসার ঘটেছিলো। মাইকেলের জনপ্রিয় নাচের মধ্যে রবোট ও মুনওয়াক (চাঁদে হাঁটা) রয়েছে। মুনওয়াক আসলে হলো সামনের দিকে হাঁটার দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করে পিছনে যাবার ভঙ্গিমা।
২০০১ সালে থ্রিলার অ্যালবামের একটি রিভাইসড এডিশন বের হয়। এরপর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৮ সালে বের হয় ডিলাক্স এডিশন থ্রিলার ২৫। যাতে নতুন একটি গান, সাক্ষাৎকারসহ যুক্ত হয় নানা ফিচার। এখনো অনেক নতুন অ্যালবামের ভিড়ে ২৮ বছরের পুরনো অ্যালবামটির বিক্রি কমেনি। অথচ, একটা সময় কৃষ্ণাঙ্গ বলে সমাজে নিচু চোখে দেখছে সবাই- এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনে প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেকে ফর্সা করে তোলেন জ্যাকসন। নিজের চেহারার কৃষ্ণাঙ্গ থেকে শ্বেতাঙ্গে রংবদল নিয়ে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয় তাকে। সব বাঁধা পেরিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মাইকেল জ্যাকসন যেন কৃষ্ণাঙ্গদের সম্মানীত করে তোলেন।
দাম্পত্য জীবনে মাইকেল জ্যাকসন ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলেন বিশ্বের সব রকস্টারের স্বপ্ন নায়ক এলভিস প্রিসলির একমাত্র সন্তান লিসা মেরি প্রিসলিকে বিয়ে করে। কিন্তু অল্প দিনেই ভাঙন আসে এই সুখের সংসারে। ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ৯৭’ সালে আবারো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন পপ সম্রাট। পেশায় নার্স এই ভদ্রমহিলার নাম ডোবরা জেনি রো। তারা দু’বছর সংসার করার পর ১৯৯৯ সালে আলাদা হয়ে যান এবং তালাকের সময় দুই সন্তানের প্রতিপালনের দায়িত্ব ডোবরা মাইকেলকে প্রদান করেন।
জ্যাকসনের তিন ছেলে-মেয়ে। পুত্র প্রিন্স মাইকেল জন্ম নেয় ১৯৯৭ সালে। মেয়ে ক্যাথরিনা ১৯৯৮ সালে। প্রিন্স মাইকেল টু নামে তার একটি পুত্র আছে যে ২০০২ সালে জন্মগ্রহণ করে।
মাইকেল জ্যাকসন দুবার রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেইমে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনিই এই পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি গানের সাথে বহুমাত্রিকতায় নাচকে (সর্বপ্রথম এবং একমাত্র), ‘আর এন বি’ হল অব ফেইমে জায়গা করে নিয়েছেন। সঙ্গীত জগতের কেউ এত ক্যাটাগরিতে হল অব ফেইমে নিজেকে নিতে পারেননি।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে মাইকেল সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী। ১৩টি গ্র্যামি পুরস্কার, ১৩টি ১ নম্বর একক সঙ্গীত, এবং ১০০ কোটিরও বেশি মাইকেলের অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। এবং এখনো বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড তাকে বিশ্বরেকর্ডে ভূষিত করেছে বিনোদন জগতের সবচেয়ে বেশি দানশীল মানুষ হিসেবে এবং তার দানকৃত অর্থের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
আরো চমকপদ তথ্য হলো মৃত্যুর পর সঙ্গীতের ইতিহাসে জনপ্রিয়তার হিসাব-নিকাশ অনেকটাই বদলে দিয়েছেন মাইকেল জ্যাকসন। নিত্য নতুন গড়েছেন সব রেকর্ড। যে বছর তিনি মারা যান সে বছরই সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবামের শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন জ্যাকসন। মৃত্যুর এক বছরের মাথায় কেবল আমেরিকাতেই তার অ্যালবাম বিক্রি হয় ৮.২ মিলিয়ন কপি। আর বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয় ৩৫ মিলিয়ন। এ ছাড়া মৃত্যুর পর তার গান ডাউনলোডের ইতিহাসেও রেকর্ড গড়েন `পপ কিং`। জ্যাকসনের মৃত্যুর পর তার নির্বাচিত গান নিয়ে প্রকাশিত তিনটি অ্যালবাম এত বেশি বিক্রি হয় যে, কোনো জনপ্রিয় শিল্পীর নতুন অ্যালবামও এত বিক্রি হয়নি। জ্যাকসনের চার-চারটি অ্যালবাম এক বছরে সর্বাধিক বিক্রিত সেরা বিশের তালিকায় জায়গা করে নেয়।
বিশ্বসঙ্গীতের এই কিংবদন্তীকে নিয়ে ঘটনার শেষ নেই। ২০০৫ সালে চাঁদে ১২০০ একরের প্লট কিনেছিলেন `পপ কিং` মাইকেল জ্যাকসন। তার মৃত্যুর পর চাঁদের একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের নাম পরিবর্তন করে `মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন` রাখা হয়। জ্যাকসনকে সম্মান জানাতেই এমনটা করেছিল দ্য লুনার রিপাবলিক সোসাইটি।
কিছু সময় বিরতির পর ২০০৯ সালের মার্চে ঘোষণা দিয়েছিলেন মঞ্চে পূণরায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে। যদিও তিনি আগের মতো ‘পারফর্ম’ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তার পারফর্ম দেখার জন্য ‘দিস ইজ ইট’ নামের শো’র টিকিট কেনার ‘ক্রেজ’ প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। লন্ডনে প্রথম শো করার ঠিক ১৮ দিন আগেই সারা বিশ্বে তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। জ্যাকসনের আচমকা মৃত্যুর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে পেইন কিলার সেবনকে দায়ী করা হয়। তবে দায়িত্বে খামখেয়ালি করার কারণে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী মার্কিন চিকিৎসক ড. কনরাড মারেকে চার বছরের জন্য কারাবাস সাজা দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক বোধ হয় কোনো দিনই শেষ হবে না। মাইকেল মারা যাওয়ার পর তাকে নিয়ে নানা নতুন নতুন তথ্য ফাঁস করে তার বাড়ির গৃহপরিচালিকা, স্বজন ও বন্ধুরা। এই তথ্যগুলোর কোনোটি বিস্মিত করেছে, কোনোটি বিষাদে মন পুড়িয়েছে ভক্তদের।
গান, নাচ ও ফ্যাশনের মাধ্যমে যে আবেগ তিনি বিশ্বময় সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে গেয়েছেন তা কোনো সঙ্গীতশিল্পীর কাছেই পাওয়া যায়নি। তিনি শুধু একজন শিল্পীই ছিলেন না ছিলেন একজন অতিমানবিকও।
জীবদ্দশায় নিজের অর্থায়নে লিউকেমিয়া এবং ক্যান্সার ইন্সটিটিউট স্থাপন করেন মাইকেল জ্যাকসন। এছাড়াও শিশুদের জন্য এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য তিনি কোটি কোটি ডলার দান করে গেছেন। ১৯৯৬ সালে তার আয়ের অর্থ দিয়ে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। নিজের সকল সৃষ্টি-সৃজনের উজ্জ্বলতায় বিশ্বমানবের কাছে আলোকিত হয়ে থাকবেন কিংবদন্তি মাইকেল জ্যাকসন।