ভারতের স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরে প্রথম বাঙালি রূপে রাইসিনা হিলসের বাসভবনে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিজেকে নিশ্চিত করলেন প্রণব মুখার্জি। এনডিএ প্রার্থী লোকসভার সাবেক স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে রোববার ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রাথী প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হলেন। আগামী ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন তিনি।
আশ্চর্যজনকভাবে তিনি শুধু ইউপিএ বা বামদলগুলোর নয় কর্নাটক ও গুজরাটের ১৪ জন বিজেপি বিধায়কের ভোট পেয়েছেন।
প্রণব পেয়েছেন পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৯টি ভোট, অন্যদিকে সাংমা পেলেন দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৫৮টি ভোট।
এদিন সকাল ১১টা থেকে রাজ্যসভার ৬৩ নম্বর কক্ষে শুরু হয় ভোট গণনা। মোট ২৭টি ব্যালট বাক্স। একটি সংসদে রয়েছে। বাকি ২৬টি বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনা হয়েছিল। ৭২ শতাংশ মোট ভোট প্রায় ১১ লাখ ভোট গণনা করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমেই ব্যালট বাক্স থেকে বৈধ ভোটগুলিকে আলাদা করা হয়। এর পর প্রথম পছন্দের ভোটগুলি গণনা করা হয়।
এদিন দুপুর ১২টা ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর দেড়টা নাগাদ জানানো হয়, প্রথমে লোকসভার ৭৪৮ জন সাংসদের ভোট গণনা হয়েছে। এতে প্রণব মুখার্জি পেয়েছেন ৫২৭টি ভোট যার ভোট মূল্য তিন লাখ ৭৩ হাজার ১১৬টি ভোট। যা মোট ভোটের ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে, পিএন সাংমা পেয়েছেন ২০৬টি ভোট। যার ভোট মূল্য এক লাখ ৪৫ হাজার ৮৪৮ ভোট।
১৫টি ভোট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ভোট ছিল প্রণব মুখার্জির পক্ষে। এরপর বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ও রাজ্যসভার ভোট গণনা শুরু হয়। প্রথমে দক্ষিণের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের ১৮৫টি ভোটের মধ্যে প্রণব পান ১৮২টি ভোট। অন্যদিকে, পিএন সাংমা পেয়েছেন মাত্র ৩টি ভোট।
এদিন ভারতের এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলো ছাড়া আর সব রাজ্যেই এগিয়ে ছিলেন প্রণব। অরুনাচল প্রদেশে প্রণব ৫৪,সাংমা ২ ও বাতিল ৩,আসামে প্রণব ১১০,সাংমা ১৩,বাতিল ২,গোয়াতে প্রণব ৯, সাংমা ৩১, ছত্তিসগড় প্রণব ৩৯, সাংমা ৫০ ও বাতিল ১,বিহার প্রণব১৪৬, সাংমা ৯০ ও বাতিল ৪,গুজরাট প্রণব ৫৯, সাংমা ১২৩।
হরিয়ানা প্রণব ৫৩, সাংমা ২৯ ও বাতিল ৮,হিমাচলপ্রদেশ প্রণব ২৩, সাংমা ৪৪,জম্মু ও কাশ্মীর প্রণব ৬৮, সাংমা ১৫, ঝাড়খণ্ডে প্রণব ৬০, সাংমা ২০, কর্নাটকে প্রণব ১১৭, সাংমা ১০৩। এই রাজ্যের ১৩ জন বিজেপি বিধায়ক প্রণবকে ভোট দিয়েছেন।
কেরালায় প্রণব ১২৪টি আর সাংমা একটিও ভোট পাননি। মধ্যপ্রদেশে প্রণব ৭৩ ও সাংমা ১২৬টি ভোট পেয়েছেন।
ভোট গণনা চলাকালীন দুপুর ২টায় প্রণব মুখার্জি আগাম শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও ইউপিএয়ের চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধি। তার বাসভবন ১৩ নম্বর তালকাটরা রোডে গিয়ে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেলট, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিত, প্রতিরক্ষামন্ত্রী একে অ্যান্টনি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম প্রমুখ শুভেচ্ছা জানান।
প্রথমে সমর্থন না করলেও ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে মমতা ব্যানার্জি গত মঙ্গলবারই অবশেষে প্রণব মুখার্জিকেই ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করেন। এনডিএ জোটের জনতা দল ইউনাইটেড ও শিবসেনা, বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল ও বামদল সিপিএম ও ফরওর্য়াড ব্লক তাকে সমর্থন দেয়। এর মধ্যে গুজরাটের বিজেপি বিধায়ক কানু কালসিরিয়া দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে প্রণব মুখার্জিকে ভোট দিয়েছেন।
এদিকে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার খবরে সারা দেশ উল্লসিত। চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগেই শুরু হয় আবির খেলা থেকে মিষ্টি বিতরণ। প্রণবের জন্মস্থান বীরভূমের কীর্ণাহারের মিরাটি গ্রাম থেকে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে আজ উৎসবের পরিবেশ।
প্রণব মুখার্জির সংক্ষিপ্ত জীবনী
ভারতীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী তিনি। ১৯৩৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের মিরাটি গ্রামে তার জন্ম। বাবার নাম কামদাকিঙ্কর মুখার্জি ও মা রাজলক্ষ্মী দেবী।
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাকালে তিনি ১০ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হন কামদাকিঙ্কর।
ভারতের রাজনীতিতে চানক্য বলে পরিচিত প্রণব মুখার্জি ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে আইন বিভাগেও পাস করেন।
একজন কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন। এ সময় ‘দেশের ডাক’ নামক একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এছাড়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল-ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন প্রণব।
১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামের শুভ্রা মুখার্জির সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ১৯৬৯ সালে প্রথম রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন প্রণব মুখার্জি। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন বেসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এ বাঙালি রাজনীতিককে কংগ্রেস দলে এবং দলের বাইরে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করেছে। সাউথ ব্লকে তিনি পরিচিত ড্যামেজ কনট্রোল ম্যানেজার রূপে।
দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ ও শ্রেষ্ঠ সংসদ সদস্যের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার এক সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবেও বিবেচিত হন।
প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক কর্মজীবন অত্যন্ত বর্ণময়। প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য তিনি। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রথমবারের মতো রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্প উন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির হত্যার অব্যবহিত পর একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হন প্রণব মুখার্জি। এ সময় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা হলে এ দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন।
পরবর্তীতে পি.ভি নরসিমা রাও তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটে। রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহের বাইপাস সার্জারির সময় তৎকালিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি রাজনীতিবিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রণব মুখার্জি ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস সেকশন ১২৩ চুক্তি সই করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য।
১৯৮৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অব টোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন।
২০১২ সালের ২২ জুলাই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন।