‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, মিছিলে জনস্রোত। নাহ, কোনো রাজনৈতিক মিছিল নয়। নব্বুইয়ের দশকের শুরুর দিকে হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর প্রধান চরিত্র বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেবার দাবি জানিয়ে এই স্বতস্ফুর্ত মিছিল।
১৯৮৮ সালে বিটিভিতে ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ মাধ্যমে এ দেশের টিভিমিডিয়ায় সূচিত হয় হুমায়ূন আহমেদ নামের নতুন এক অধ্যায়। মেলোড্রামাটিক ফর্মূলা ভেঙে নাটকের আর সংলাপে জীবনের স্বাভাবিক রূপ নিয়ে আসেন তিনি। হয়ে উঠেন মধ্যবিত্ত মানুষের আনন্দ-বেদনার রূপকার। চ্যানেল ছিল তখন একমাত্র বিটিভিই। ‘এইসব দিনরাত্রি’ যখন প্রচার হতো রাস্তাঘাট হয়ে যেতো ফাঁকা। জাদুকরী আকর্ষণ তৈরি করেন হুমায়ূন আহমেদ তার আগমনেই। নাটকে শফিক চরিত্রে বুলবুল আহমেদ, রফিক চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর নীলুভাবী চরিত্রে ডলি জহুর যেন ঠিক আমাদের পাশের বাড়ির মানুষ। ছোট্ট টুনির মৃত্যুর মাধ্যমে ধারাবাহিকটির ইতি টানেন হুমায়ূন আহমেদ। পরদিনই প্রেস ক্লাবের সামনে টানানো হলো ব্যানার ‘টুনির কেনো মৃত্যু হলো, হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই’।
একই ঘটনা ঘটলো নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকের ক্ষেত্রেও। বাকের ভাইকে বাঁচানোর দাবিতে মিছিল-দেয়াল লিখন-সমাবেশ সবই হলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত গল্পের যবনিকা টানতে গিয়ে বাকের ভাইকে ঝুলতে হলো ফাঁসিতে। একটি টিভি নাটক নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে, তার দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাকের ভাই চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর এখনও হয়ে আছেন মার্কা মারা। নাটকটি প্রচারের প্রায় দুই দশক পর আসাদুজ্জামান নূর যখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তাকে সামনে রেখে বাকের ভাইয়ের নাম ধরেই নীলফামারী ভোট চাওয়া হয়েছে এবং মানুষ বাকের ভাইকে প্রত্যাখান করেন নি। চরিত্র সৃষ্টিতে এমনই এক নিপুন কারিগর ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
একইভাবে হুমায়ুন আহমেদের ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’ আর ‘আজ রবিবার’ নিয়ে প্রবল আবেগ তৈরি হয়েছে মানুষের মাঝে। টিভি নাটকের দর্শককে কিভাবে কাহিনীর মাঝে আটকে রাখা যায়, একাত্ম করা যায় তা খুব ভালোই জানতেন হুমায়ূন আহমেদ। ঈদ মানেই ছিল তার নাটক, কিছু সময়ের জন্য নির্মল বিনোদন ছিল নিশ্চিত। হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটকটি ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙালির অন্যতম প্রধান বিনোদন মাধ্যম। ঈদের রাতে সপরিবারে মানুষ দেখতে বসতো তার নাটক। বিভিন্ন বাড়ির খোলা জানালা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত আনন্দময় হাস্যধ্বনি শোনা যেতো। জানিয়ে দিতো হুমায়ূন আহমেদ নামের এক জাদুকর নাট্যকার সবার মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে। একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটেছে বছরের পর বছর।
সহজিয়া ভঙ্গিমার সাহিত্যের মতোই টিভি নাটকের ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ মানেই যেন আলাদা কিছু। সাধারণের সহজ-সরল জীবনযাপন থেকে তুলে আনা গল্পের অসাধারণ প্রকাশ। আজ কোন চ্যানেলে প্রচার হবে হুমায়ূন আহমেদের কোন নাটক- এমন কোন খবর জানতে পারা মানেই দর্শকদের সেই নাটক দেখায় হুমড়ি খেয়ে পড়া ছিল নিয়মিত ঘটনা।
১৯৯৫-এর পরবর্তী সময়ে আসে বিটিভিতে আসে ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত প্যাকেজ প্রোগাম প্রচারের সূযোগ। ১৯৯৭ সাল থেকে দেশে একটার পর একটা স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আসা শুরু হয়। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠেন নির্মাতা-পরিচালক। টিভি চ্যানেলগুলোর বানিজ্যিক চাপে পড়ে বেড়ে যায় হুমায়ুন আহমেদের নাটক রচনা আর পরিচালনার সংখ্যা। চাপের মুখে অতিরিক্ত নাটক তৈরি করতে গিয়ে কিছুক্ষেত্রে একঘেয়ামী চলে আসলেও প্রাণের স্পন্দন ছিল তার সব নাটকেই।
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে ঈদের টিভি অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল হুমায়ূন আহমেদের নাটক। মধ্যবিত্ত মানুষের ঈদ উৎসবে পোলাও-কোর্মা, ফিন্নি-সেমাই আর নতুন জামা-কাপড়ের সঙ্গে হুমায়ূনের ঈদের নাটকও ছিলো উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। ঈদের সারা দিনের নানান সামাজিক-পারিবারিক আমন্ত্রন-নিমন্ত্রন, সৌজন্য-সাক্ষাৎ, ভোজের আয়োজন এবং অতিথি আপ্যায়নের বিচিত্র ঝক্কি-ঝামেলার পর সন্ধ্যায় টিভি সেটের সামনে আয়েস করে বসে দর্শকরা দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদের নাটক।
একদিন হঠাৎ, খাদক, অন্যভুবন, অচীনবৃক্ষ, খোয়ব নগর, জোছনার ফুল, আজিজ সাহেবের পাপ, আমরা তিনজন, ভূত বিলাস, বুয় বিলাস, এই বৈশাখে, চৈত্রদিনের গান, নাট্যকার হামিদ সাহেবের একদিন, পক্ষীরাজ, জুতা বাবা, তারা তিনজন-টি মাষ্টার, তৃষ্ণা, রূপালী রাত্রি, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, বাদল দিনের প্রথম কদমফুল, ঘটনা সামান্য, চেরাগের দৈত্য, তুরুকের তাস, বৃক্ষ মানব, এই বসন্তে প্রভৃতি অসংখ্য নাটকের মাধ্যমে তিনি মানুষকে বিনোদিত করেছেন।
দর্শক চাহিদার আকাশচুম্বী অবস্থার কথা বিবেচনা করেই দেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে- কে কত বেশি হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত নাটক প্রচার করতে পারে। প্রতি ঈদেই দেশের শীর্ষ টিভি চ্যানেলগুলো তাদের প্রাইম টাইম ঠিক করে রাখে হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত নাটক প্রচারের জন্য। এবারও তেমন পরিকল্পনাই আঁটছিলেন এসব চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু আকস্মিক দুঃসংবাদ। হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন অন্যভুবনে।
হায়, আমাদের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে আমরা প্রতি ঈদের উপহার হিসেবে নতুন নতুন নাটক আর পাবো না।