করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে সারাবিশ্বের মতো দেশের পরিস্থিতিও অনেকটাই থমকে গেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আগামী ২ জুন বসছে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে নানা সীমাবদ্ধতায় অনেক খাতেই বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হয়নি। সেসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নতুন বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আগামী ৩ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপিত হবে।
জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তাসহ নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ পাচ্ছে এ খাত। সব মিলিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ পাচ্ছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
করোনা কতদূর যাবে, আবার কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা তো জানি না। যদি আবার ম্যাসিভ রেশনিং করতে হয়, ওএমএস দিতে হয়, করোনার কারণে অনেকে কর্মহীন হয়েছে। আমরা যদি সহায়তার পরিধি বাড়াই, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর খাদ্য লাগবে
সূত্র বলছে, খাদ্য মজুত কম থাকাসহ নানান কারণে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি খাদ্য মন্ত্রণালয়। ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন ‘টিআর-কাবিখা’র মতো কর্মসূচিতে খাদ্য সরবরাহ করতে পারেনি তারা।
তাই সরকারিভাবে খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে খাদ্যের বিনিময়ে নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। এতে দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ খরচ হলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সেই টাকা রয়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ অনেকটা গত অর্থবছরের মতোই থাকছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুকূলের বরাদ্দ দেয়া অর্থের অনেকটাই উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে। কিন্তু সামনে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা কর্মসূচির প্রয়োজন হতে পারে। ২০২০-২১ বছরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তা বাড়তে বা কমতে পারে। এছাড়া এর বাইরে টাকার প্রয়োজন হলে থোক বরাদ্দ থেকেও আর্থিক প্রয়োজন মেটানো হবে। তবে সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বাজেটে গুরুত্ব পাবে।
আমরা মনে করছি যতটুকু আমাদের বৃদ্ধি হবে সেটি দিয়ে ভালোভাবেই আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব। চলতি অর্থবছরে ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, এবার ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। টিআর, কাবিখা সম্পূর্ণরূপে টাকায় কনভার্ট করেছি, যেটা ত্রাণ মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী আমরা যে খাদ্যটা সরবরাহ করি এবার তো সেটা করিনি। টিআর, কাবিখার টাকা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের থেকে দেয়া হয়েছে, সুতরাং আমাদের টাকা রয়ে গেছে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার কারণে বাড়তি খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে, এমন ভাবনা থেকে বাড়তি প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ থেকে চলতি বছরের শুরু পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি অনেকটা ভালো থাকায় বাড়তি সহায়তার প্রয়োজন হয়নি।
করোনাসহ নানা কারণে চলতি অর্থবছরে ‘টিআর-কাবিখা’র মতো কর্মসূচিতে খাদ্য সরবরাহ করা যায়নি
তবে গুদামে খাদ্যের মজুত যে পরিমাণ থাকার কথা সেই পরিমাণ স্টক না থাকায় বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু চাল আমদানি করে যখন এসব সঙ্কট থাকবে না তখন এ পণ্যের দাম কমে যাবে। তাই অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি খাদ্য আমদানিও অব্যাহত রাখা হবে। এছাড়া আনুষঙ্গিক সঙ্কটের কথা মাথায় রেখেই বাজেটে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (১৩ মে) পর্যন্ত খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ৫ দশমিক ৯৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৩ দশমিক ২২ লাখ টন এবং গম ২ দশমিক ৭২ লাখ টন। গত আমন মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার পূরণ না হওয়ায় আমদানির পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় বিদেশ থেকে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। গত এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। অতিরিক্ত আরও তিন লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলওআই (লেটার অব ইনটেন) প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া ২ লাখ টন আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে। এসব চুক্তির মধ্যে ২ লাখ ৬৩ হাজার টন চাল ও আড়াই লাখ টন গম দেশে পৌঁছেছে।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ধানের বাম্পার ফলনের কথা বলছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যদিও হার্ভেস্টিংয়ের পর ফাইনাল হিসাব দেবে পরিসংখ্যান ব্যুরো। কৃষি মন্ত্রণালয়ের টার্গেট অনুসারে আমরা দেখছি ২ কোটি ৫ লাখ মেট্রিক টন তাদের লক্ষ্যমাত্রা। এই পরিমাণ যদি উৎপাদন নাও হয় কিংবা ২ কোটি মেট্রিক টন হয়, তাহলে আপাতত আমরা ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘সেটা অনুমোদন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আর পাশাপাশি একটা টেন্ডার কার্যক্রমও চালাব। কারণ এই ধান-চাল নিয়েই আমাদের আমনের ফলন পর্যন্ত যেতে হবে। সেজন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল, এ বছর ততটা টার্গেট করিনি। তবে আমদানির কার্যক্রমও চলবে।’
‘করোনা কতদূর যাবে, আবার কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা তো জানি না। যদি আবার ম্যাসিভ রেশনিং করতে হয়, ওএমএস দিতে হয়, করোনার কারণে অনেকে কর্মহীন হয়েছে। আমরা যদি সহায়তার পরিধি বাড়াই, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর খাদ্য লাগবে। সেজন্য আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে আমদানির কার্যক্রমও চালাব।’
গত মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারের গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি
২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব বলেন, ‘বাজেটে বরাদ্দ অনেকটা গত বছরের মতোই থাকবে। গত বছর বাজেট থাকা সত্ত্বেও আমরা খাদ্য সংগ্রহ করতে পরিনি। আমাদের বাজেট কিছুটা উদ্বৃত্ত ছিল। আমরা আশা করছি এ বছর আমাদের উদ্বৃত্ত থাকবে না। প্রায় একই বাজেটে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব। আমাদের বাজেট অল্প কিছু বাড়ছে। গতবার যেহেতু সম্পূর্ণ বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারিনি, আমাদের বাজেট রয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করছি যতটুকু আমাদের বৃদ্ধি হবে সেটি দিয়ে ভালোভাবেই আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব। চলতি অর্থবছরে ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, এবার ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। টিআর, কাবিখা সম্পূর্ণরূপে টাকায় কনভার্ট করেছি, যেটা ত্রাণ মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী আমরা যে খাদ্যটা সরবরাহ করি এবার তো সেটা করিনি। টিআর, কাবিখার টাকা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের থেকে দেয়া হয়েছে, সুতরাং আমাদের টাকা রয়ে গেছে।’
এদিকে আগামী অর্থবছরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তসহ নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্য বা স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু রাখাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
এছাড়া অগ্রাধিকার খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সফল বাস্তবায়ন, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা এবং ক্ষতিপূরণ, অধিক খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজ প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা, ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ, গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ (মুজিববর্ষের প্রধান কার্যক্রম), শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হবে।