যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রধান ঘাতক বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটররা।
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপনের সময় তারা বলেন, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম ও শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন মুজাহিদ।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইবুন্যালে ২৯ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও মীর ইকবাল হোসেন।
প্রসিকিউটররা মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭ ধরনের ৩৪টি অভিযোগ তুলে ধরেন। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছাড়া অন্য অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করার বিভিন্ন ঘটনা।
ওপেনিং স্টেটমেন্টে বলা হয়, ১৯৭১ সালে জামায়াতের ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা মুজাহিদ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনীর দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব একক ও যৌথভাবে মুজাহিদের ওপরই বর্তায়। কেননা, পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন।
প্রসিকিউটররা অভিযোগ করেন, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট দখল করে নির্যাতন ক্যাম্প তৈরি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প বসায়।
জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযম, নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি ও পরবর্তীতে সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ওই সেনা ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত ‘বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানে’ মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেন বলেও অভিযোগ আনা হয়।
শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যাকাণ্ডে মুজাহিদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে প্রসিকিউশন অভিযোগ করেন, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৩টার দিকে মুজাহিদের নেতৃত্বে ৭/৮ জন রাইফেলধারী আলবদর সিরাজ উদ্দিনের চামেলীবাগের বাসায় গিয়ে তাকে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তিনি নিজের পরিচয় দিলে মুজাহিদের নির্দেশে রাইফেলধারী যুবকরা সিরাজ উদ্দিনকে একটি মিনিবাসে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমন কি লাশও পাওয়া যায়নি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকার চামেলীবাগে। একাত্তরের ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি ‘ভাষ্যকার’ ছদ্মনামে ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেশীয় দোসরদের হাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন।
ওই প্রবন্ধ প্রকাশের পর জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। মুজাহিদের লেখা ওই প্রবন্ধে সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ আখ্যায়িত করে তার সমালোচনা করা হয়।
এর আগে ২৩ আগস্ট রাতে মুজাহিদের সহায়তা ও নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যায় সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান রুমি, জুয়েল ও আজাদকে। তাদেরকে আটকে রাখা হয় নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের ক্যাম্পে।
৩০ আগস্ট রাত ৮টায় মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামী সেখানে আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে মুজাহিদ ও নিজামি গালিগালাজ করে। উপস্থিত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে তারা বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই এদের হত্যা করতে হবে।
এরপর তারা আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ জনকে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুম করে। জহির আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তাদের এতো নির্যাতন চালানো হয় যে, মৃতদেহও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
প্রসিকিউটররা আরো বলেন, “১৬ ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যেসব বুদ্ধিজীবীদের খোঁজ পাওয়া যায়নি, তাদের লাশ মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজার বাধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে।” তখন আলী আহসান মুজাহিদের নেতৃত্বে অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান তিনিও।
তারা বলেন, “মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের দুস্কৃতকারী বলেছেন। দুস্কৃতকারীদের নির্মূল করা হবে, তাদের প্রতিফল ভোগ করতে হবে- এমন বিবৃতিও দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে সব ঘটনার অপরাধের জন্য মুজাহিদই দায়ী।”
তারা বলেন, “ছাত্রসংঘের নেতারা আর্মির চেয়ে বেশি নির্দেশ মানতো মানবতাবিরোধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আসাম দখল করতে চেয়েছিল। তারা সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। এজন্য এ কথা বলেছিল তার বক্তৃতায়। তারা বলেছিল, দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তান ভাঙতে পারবে না।”
প্রসিকিউটররা বলেন, “মুক্তিকামীদের ভারতীয় এজেন্ট, দুস্কৃতকারীসহ নানাভাবে অবহিত করে মুজাহিদ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য বক্তব্য দিয়েছিলেন ৭১ সালে।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সূচনা বক্তব্যে আরো বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদ মুক্তিকামী জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের চর বলে আখ্যায়িত করেছিল। বাঙালি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস যুবকদের ইসলাম রক্ষায় সর্বশক্তি ও প্রয়োজনে ভারতেরর সীমান্তে গিয়ে ইসলাম এবং শান্তি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আদেশ দেন।”
ঢাকার অন্য হত্যা ও নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এছাড়াও মুজাহিদ মতিঝিলের ফকিরাপুলের গরমপানির গলির রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন করেন।”
সূচনা বক্তব্য থেকে জানা গেছে, মুজাহিদ ওই সময় প্রথমে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ফরিদপুরের দায়িত্ব নেন। পরে ঢাকা থেকে আস্তে আস্তে পাকিস্তানের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন।” পর্যায়ক্রমে তিনি জামায়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রসিকিউটররা জানিয়েছেন, আর এসব সম্ভব হয়েছে তার বাবা পাকিস্তানের সময় যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। এ ক্ষমতাবলে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর জেলায় সাধারণ মানুষকে হত্যা-নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী কাজে জড়িত হন মুজাহিদ।
এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানেও মানবতাবিরোধী অপরাধে জাড়িত ছিলেন তিনি।
৩৪টি ঘটনার মধ্যে ফরিদপুরে সংঘটিত ৪টি সুনির্দিষ্ট ঘটনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন ভোরে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার বৈদ্যডাঙ্গী, মাঝিডাঙ্গী ও বালাডাঙ্গীতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনা ও আলবদর বাহিনী।
ওইদিন মুজাহিদের নির্দেশে সংখ্যালঘু গ্রামগুলোতে প্রায় ৬০ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন। এ সময় বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটও চালায় মুজাহিদের নেতৃত্বে রাজাকার-আলবদর ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
জুনের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়াল চামট থেকে (রথখোলা) রমেশচন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ বাবুকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকার সদস্যরা।
এরপর ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর সামনে তাকে হাজির করা হয়। ওই সময় মুজাহিদের নির্দেশে কয়েকজন রাজাকার ও বিহারি যুবক বাবুকে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং একটি দাঁত তুলে ফেলে।
নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে একটি বাড়িতে আটকে রাখা হলেও রণজিৎ জানালার শিক বাঁকা করে ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা থেকে আবু ইউসুফ পাখিকে আটক করে স্থানীয় রাজাকাররা। এরপর তাকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে বসানো সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখা হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, মুজাহিদের নির্দেশে ওই ক্যাম্পে পাখির ওপর অমানবিক নির্যাতন চলে। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে নির্যাতনের ফলে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়। পরে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এর আগে ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় নতুন একটি অভিযোগ ও ৭ জন নতুন সাক্ষীকে আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। সেটি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর আড়াইটায় ফরিদপুরের বকচর গ্রামে।
প্রসিকিউটররা তাদের বক্তব্যে ওই ঘটনারও উল্লেখ করেন। তারা জানান, হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রাম থেকে নিরেন্দ্র সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধার মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাসহ আরো অনেককে ধরে নিয়ে যান মুজাহিদ ও তার সহযোগীরা। গ্রামের গৃহবধূরা মুজাহিদকে বেশ কিছু গায়ের গহনা ও টাকা-পয়সা দিয়েও তাদের বাঁচাতে পারেননি।
মুজাহিদরা তাদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেন, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন।
উল্লেখ্য, গত ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি ঘটনাসহ ৩৪টি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন শেষে আগামী ২৬ আগস্ট মুজাহিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল-২।