বাংলা কথাসাহিত্যে অসামান্য ক্ষমতাবান লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ ও তার পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্ক অবস্থানরত প্রকাশক মাজহারুল ইসলামের মাধ্যমে লেখকের জীবনাবসনের খবরটি ঢাকায় আসে। খুব কম সময়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশ জুড়ে নেমে আসে শোক। মিডিয়া জগতেও নেমে আসে শোকের ছায়া।
নন্দিত লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন তারকার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করে ।
আসাদুজ্জামান নূর : হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে আমি স্তম্ভিত। কিছু বলার মতো ভাষা আমার নেই। অনুভব করছি বিশাল শূণ্যতা। কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় আসার পর আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। খুব আশা করেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।
আলী যাকের : অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন হুমাযূন আহমেদ। তার জ্ঞানের পরিধিও ছিল বিশাল। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাগুলো সবসময়ই ছিল ভীষণ আনন্দের। বাংলাদেশের সাহিত্যকে মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে হুমায়ূন আহমেদ পালন করেছেন বিশাল দায়িত্ব। তার শূণ্যতা পূরণ হওয়ার মতো নয়।
জাহিদ হাসান : আপনজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি। আমাকে তিনি খুব আপন করে নিয়েছিলেন। একটা ভালো চরিত্র লিখলেই তিনি আমার কথা ভাবতেন। হুমায়ূন আহমেদ আর আমাকে তার তৈরি করা চরিত্রে অভিনয় করতে ডাকবেন না। এটা ভাবতেই বুক ভেঙে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।
মাহফুজ আহমেদ : হুমায়ূন স্যার আমার পিতৃতুল্য মানুষ ছিলেন। অনেক অনেক দিয়েছেন তিনি আমাকে। তার ঋণ শোধ করার মতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেন নি। হুমায়ূন স্যার নেই, এ খবরটি কিছুতেই আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু সত্য যতো কঠিন হোক, স্বীকার করে নিতেই হবে। আমি স্যারকে হারিয়ে বাবা হারানোর ব্যথা অনুভব করছি।
জয়ন্ত চট্যোপাধ্যায় : আমি ছিলাম আবৃত্তি শিল্পী, আমাকে অভিনেতা হিসেবে জন্ম দিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। তিনি আমার ভেতরের অভিনেতা স্বত্তাটাকে জাদুকরী কায়দায় বের করে এনেছিলেন। গত তিন-চার বছর ধরে আমি হয়ে উঠেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকের নিয়মিত অভিনেতা। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ভেবেই লিখতেন অনেক চরিত্র। খুব আপন করে নিয়েছিলেন তিনি আমাকে। তার মৃত্যুর খবর শুনে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছি।
ডলি জহুর : খুব মনে পড়ছে ‘এইসব দিনরাত্রী’ নাটকে অভিনয়ের সেই দিনগুলোর কথা। এতোটা সিরিয়াসভাবে আর কখনো অভিনয় করেছি বলে মনে পড়ে না। হুমায়ূন আহমেদের এই একটি নাটকে অভিনয় করে যে পরিচিতি পেয়েছি, তা অভাবনীয়। মানুষ আজও আমাকে ‘নিলু ভাবী’ নামে চেনে। অনেকদিন হুমায়ূন আহমেদের নাটকে কাজ করিনি। হয়তো তিনি বেচে থাকলে সুযোগ পেতে পারতাম। খুব কষ্ট হচ্ছে তার মৃত্যুতে।
তানিয়া আহমেদ : আমি আমার এই জীবনে যে ক’জন বড় মাপের মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছি, তার মধ্যে অন্যতম হলেন হুমায়ূন আহমেদ। খুব অল্প সময়েই তিনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিগুলো আমার খুব মনে পড়ছে। হুমায়ূন স্যার বেচে থাকলে বাংলাদেশকে আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন।
বারী সিদ্দিকী : হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আমার ভেতরে কে যেন কেবল একটি গানই গাইছে, সোয়াচান পাখি আমি জেগে আছি তুমি ঘুমাইলা নাকি..। আমার কণ্ঠে এই গানটা স্যার খুব পছন্দ করতেন। একসময় প্রায়ই তিনি আমার কণ্ঠে এ গানটি শুনতে চাইতেন। উনার মৃত্যুতে শোক প্রকাশের মতো ধৃষ্টতা আমার নাই, আমি নিতান্তই একজন ক্ষুদ্র গায়ক।
একনজরে হুমায়ূন আহমেদ
ডাক নাম : কাজল [শামসুর রহমান]
জন্ম তারিখ : ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর
জন্ম স্থান : নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে
বাবা : ফয়জুর রহমান আহমেদ [মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা]
ভাইবোন : তিন ভাই তিন বোন [সবার বড়]
শৈশব-কৈশোর : নেত্রকোণা, দিনাজপুর, বগুড়া, সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, বরিশাল।
পড়াশোনা : এসএসসি [বগুড়া জিলা স্কুল- ১৯৬৫], এইচএসসি [ঢাকা কলেজ ১৯৬৭], স্নাতকোত্তর [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় /রসায়ন -১৯৭২], পিএইচডি [মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি /বিষয় পলিমার রসায়ন -১৯৮০]
প্রথম কর্মস্থল : ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় [প্রভাষক]
দ্বিতীয় কর্মস্থল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [অধাপক, রসায়ন বিভাগ]
প্রথম বিয়ে : গুলতেকিন আহমেদ [১৯৭৩]
প্রথম পক্ষের সন্তান : তিন মেয়ে ও এক ছেলে
দ্বিতীয় বিয়ে : মেহের আফরোজ শাওন [২০০৫]
দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান : দুই ছেলে
প্রথম উপন্যাস : নন্দিত নরকে [প্রকাশক: খান ব্রাদার্স- ১৯৭২]
উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নী, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, শূন্য, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, শ্যামল ছায়া, ছায়াবীথি, নত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প, মর্ধ্যাহ্ন, দেয়াল প্রভৃতি।
উল্লেখযোগ্য নাটক : এইসব দিনরাত্রী, বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, উড়ে যায় বকপী, খাদক, একদিন প্রতিদিন, হাবলঙ্গের বাজারে, চেরাগের দৈত্য, ভূতের বাচ্চা সোলায়মান, এই বৈশাখে, নত্রের রাত, তারা তিনজন, আজ জরির বিয়ে, এই বর্ষায়, গুণীন, রুমালী, পুস্পকথা, সবাই গেছে বনে, পাপ, ওপেনটি বায়োস্কোপ, ভেজাবো চোখ সমুদ্দুর জলে, নিতু তোমাকে ভালোবাসে, মফিজ মিয়ার চরিত্র, কুহক এবং আরো অনেক।
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল, ঘেটুপুত্র কমলা [মুক্তি প্রতিক্ষীত] ।
পুরস্কার : বাংলা একাডেমী (১৯৮১), শিশু একাডেমী, একুশে পদক ১৯৯৪, জাতীয় চলচ্চিত্র (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), বাকশাস (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক. অন্যদিন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ড, মেরিল প্রথম আলো অ্যাওয়ার্ড, বাচসাস পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।