প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অমান্য করে ও আদালত অবমাননার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ চলছে। একাজে আইনের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে ভূমি মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া ও মাঝেরচর এলাকায় বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের দীর্ঘমেয়াদী লিজ নেওয়া ভূমি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দখল ও অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ বেআইনি।
উল্লেখ্য, সরকারের অনুমোদন নিয়েই দীর্ঘমেয়াদী লিজ নবায়নের সংশোধনী দলিল ও রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনোয়ারায় ৮৪.৫৫ একর জমি গ্রহণ করা হয়। সেই থেকে ওই জমির প্রতি শতকে ১২৫ টাকা করে নিয়মিতভাবে শিল্প হারে খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে।
এছাড়া, ওই বছরের ৪ জুন রাঙ্গাদিয়ার শাহাদৎ চৌধুরী নামের এক স্থানীয় বাসিন্দার ৬.৯০ একর পৈতৃক সম্পত্তি দানপত্র দলিলের মাধ্যমে গ্রহণ করে বসুন্ধরা গ্রুপ। আর কর্ণফুলী নদীর তীরে মাঝেরচর মৌজার ২৬৪ একর জমি চট্টগ্রাম বন্দর আইন ১৯১৪ অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষের ডাকা দরপত্রে সাড়া দিয়ে, ৬টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ৫০ বছর মেয়াদী লিজ এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট।
এসব জমিকে কোনোভাকেই খাস জমি বলা যাবে না। প্রকৃত অর্থে বসুন্ধরা গ্রুপ এসব জমিতে মালিক ও স্বত্ববান হিসেবেই রয়েছে।
আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ করা হয়নি এমন জমিও রিকোয়ারিং বডিকে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ এ জমি ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট এবং বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এর অনুকূলে স্থায়ীভাবে বন্দোবস্তকৃত ও আইনগতভাবে বৈধ।
এর আগে, ২০১০ এর ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নোটে ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নতুন রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশনা দেন। কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে, রিপোর্ট দাখিল না করে সরাসরি অধিগ্রহণ অনুমোদন হয়েছে মর্মে জেলা প্রশাসনকে জানায় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এ আচরণ প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা, কর্তৃত্ব ও আইনের প্রতি প্রতারণার শামিল।
উল্লেখ্য, বসুন্ধরার উদ্যোগে একটি অয়েল রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য নির্ধারিত সম্পত্তি অধিগ্রহণ- বহির্ভূত রাখা হবে এই মর্মে মৌখিকভাবে কথাও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও বিষয়টি নিশ্চিত করতে তৎক্ষণাৎ বর্তমান জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী এবং তৎকালীন মুখ্য সচিব এম এ করিমকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবারও জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও মুখ্য সচিবকে রিফাইনারি বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন। এছাড়াও জমি অধিগ্রহণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে জানিয়ে দেওয়ারও আদেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু এ সব নির্দেশনার প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েই আনোয়ারায় চলছে কয়লা বিদ্যুতের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির একটি প্রতিবেদনেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ওই কমিটির প্রতিবেদনে আনোয়ারার পরিবর্তে বাঁশখালী থানার খানখানাবাদে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
এ অবস্থায় কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড স্থাপনের জন্য আনোয়ারা মৌজায় জমি অধিগ্রহণ জনস্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আগেই কয়লা মজুদের জন্য জমি অধিগ্রহণকে অযৌক্তিক ও জনস্বার্থ বিরোধী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও ভুল থাকায় এ সংক্রান্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুলনিশি জারি করে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো) বজায় রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু প্রতিপক্ষ সিপিএলএ দাখিল করে চেম্বার জজের মাধ্যমে স্ট্যাটাস কো স্থগিত করে। তবে গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর আদালতে মামলাটি অগ্রগাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হবার কথা রয়েছে।
তফসিলভূক্ত ওই সম্পত্তিতে বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ও ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ৫৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা জনস্বার্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে অয়েল রিফাইনারি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার ও পরোক্ষভাবে ২ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
উল্লেখ্য, এই জমি বাবদ বসুন্ধরা গ্রুপ জেলা প্রশাসনকে নিয়মিতভাবে শিল্পভূমি হারে খাজনা দিয়ে আসছে, লিজ ভাড়া বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বছরে ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে আসছে, ভ্যাট ও উৎসে কর পরিশোধ করছে বছরে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এছাড়াও শিল্প স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ভূমি উন্নয়ন, সীমানাবাঁধ নির্মাণ, ভাঙ্গন রোধের ব্যবস্থা, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে এ জমিকে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়েছে।
আনোয়ারায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কয়লার ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণ।
দেশের বৃহত্তর চাহিদার প্রতি দৃষ্টি রেখে বসুন্ধরা গ্রুপ আনোয়ারায় একটি তেল শোধনাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় সর্বমহলের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার জমি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডাম্পিং ইয়ার্ড করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন না করে এ বিষয়ে কমিটির রিপোর্ট অনুসরণে জোর দিতে হবে।
এ লক্ষ্যে জ্বালানি উপদেষ্টা, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, ভূমি সচিবদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত নির্দেশনা প্রয়োজন।