পদ্মাসেতু প্রকল্পে বাতিল করা ঋণ আবার চালু করা ‘অসম্ভব নয়’ বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক।
মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ কার্যালয় থেকে পাঠানো ‘পদ্মাসেতু প্রকল্প বাতিল সংক্রান্ত প্রশ্ন-উত্তর’ শীর্ষক এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলেছে, এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ খুব সীমিত। কারণ প্রস্তাবিত চারটির মধ্যে দুটি পদক্ষেপে পদ্মাসেতু প্রকল্পের দুর্নীতির প্রমাণ দানের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনার পরও সরকার এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিতে পারেনি।
বিবৃতিতে পদ্মাসেতুর ঋণ বাতিলের বিষয়টিকে ‘দুঃখজনক ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য যেমন দুঃখজনক, তেমনি দুঃকজনক বিশ্বব্যাংকের জন্যও। তবে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ব্যাপক কর্মসূচির ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব পড়বে না। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে এবং দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে এবং সুশাসনের ভিত্তির ওপর একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার ও স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে জনজীবনের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
বিবৃতিতে পদ্মাসেতুতে ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্তটিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ হিসেবে দাবি করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্টের শেষ কার্যদিবসে বাতিল হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বিবৃতিটি প্রতিষ্ঠানের নয় বরং তার ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন বলে সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যে ইঙ্গিত করেছেন, তা সঠিক নয়। বিশ্বব্যাংকের সকল সিদ্ধান্তই প্রাতিষ্ঠানিক, কোনটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এটি বিশ্বব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত ছিলো, কারও একক সিদ্ধান্ত নয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের দুর্নীতি মোকাবিলা করার সদিচ্ছার অভাব এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।’
বিবৃতিতে পদ্মাসেতুর ঋণ বাতিলের সপক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘বিশ্বব্যাংক প্রায় এক বছর ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক যে, সরকার প্রায় নয় মাসেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পদ্মাসেতুর সম্ভাবনা এবং জনজীবনে এর গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক একটি উপায় বের করার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের দলও পাঠিয়েছিল। কয়েকদিনের আলোচনার পর, ৪টি প্রস্তাবের ২টির ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে করা সম্ভব নয় জানানোর পর বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিলের কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হয়।’
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে যে চারটি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিল এগুলো হচ্ছে- প্রথমত: দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক টিম গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাতে দুদক সম্মতি দিয়েছিলো।
দ্বিতীয়ত: সরকার একটি বিকল্প প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছিল যেখানে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য ক্রয় প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ ছিল।
তৃতীয়ত: দুদককে বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বাইরের প্যানেলের কাছে তথ্য দেওয়ার এবং প্যানেলকে তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুদক বাইরের প্যানেলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করার কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখার বিষয়টি মেনে নেয়নি।
সবশেষে সরকার বাংলাদেশি আইনের আওতায় থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে সরকারি ব্যক্তিবর্গ (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) ছুটি দিতে রাজি হননি। এ চারটি সুপারিশের মধ্যে দুটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছুতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের পক্ষে সেতুর জন্য সহায়তা বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
প্রাক-যোগ্যতা বাছাইকালীন সময়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষপাত নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে এ বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি একেবারেই সত্য নয়। বিশ্বব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শন করে না। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যখন কোনো প্রকল্প হয়, তখন এটি সরকারের দায়িত্ব থাকে যে, প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় সেটি সক্ষম কি নাÑ তা মূল্যায়নের নায্যতা প্রদান করা। এক্ষেত্রে সেতু বিভাগ ‘চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন’কে যথেষ্ট তথ্যাদি ছাড়াই প্রাক-যোগ্যতা থেকে বাদ দিয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সেতু কর্তৃপক্ষকে আরো তথ্য চাইতে ও প্রয়োজনীয় যথার্থতা প্রদানে অনুরোধ করে।
বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক আরো বলেছে, বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ও ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেশ করেছে। এসব সুপারিশমূলক রিপোর্টের গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারসহ প্রত্যেক সদস্য দেশের কাছে বিশ্বব্যাংকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এ সকল রিপোর্ট ও চিঠিসমূহ চাইলে প্রকাশ করতে পারে।