‘পাখি উড়ে যায়, তার পালক পরে রয়’ , আমাদের চলচ্চিত্রের মহানয়ক বুলবুল আহমেদ দু‘বছর আগে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। রয়ে গেছে তার অভিনীত অনন্য কিছু ছবি। সব চরিত্রেই দারুণ মানানসই এই অভিনেতা বেঁচে থাকবেন তার অভিনয়ের মাঝে। বুলবুল আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি বাংলানিউজের শ্রদ্ধাঞ্জলী।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহানায়ক হিসেবে খ্যাত বুলবুল আহমেদের জন্ম পুরান ঢাকার আগামসিহ লেনে ১৯৪১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর । তার আসল নাম তাবারক আহমেদ, বাবা-মা আদর করে ডাকতেন বুলবুল নামে। বাবা খলিল আহমেদ ছিলেন সরকারী কমকর্তা। তিনি একসময় মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি অভিনয় করতেন, নাটক রচনা করতেন। বাবার অভিনয় দেখেই ছোটবেলা থেকে বুলবুল আহমেদের অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
বুলবুল আহমেদ পড়াশোনা করেছেন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে তিনি জড়িত ছিলেন মঞ্চাভিনয়ে। পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি চাকরি জীবন শুরু করেন তৎকালীন ইউবিএল ব্যাংক টিএসসি শাখার ম্যানেজার হিসেবে ।
মঞ্চানাটকে অভিনয়ে সূত্রেই নাট্যকার-নির্মাতা প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে বুলবুল আহমেদের পরিচয় ছিল। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র চালু হওয়ার পর আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘বরফ গলা নদী’ ছিল বুলবুল আহমেদের প্রথম টিভি নাটক। এরপর নিয়মিত তিনি নাটকে অভিনয় করতে থাকেন। সে সময় বুলবুল আহমেদ অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘মালঞ্চ’, ‘ইডিয়ট’, ‘মাল্যদান’, ‘বডদিদি’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রভৃতি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম পরিচালিত ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। তার পর্দা উপস্থিতি প্রশংসিত হওয়ায় ১০ বছরের ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলচ্চিত্রকে পথ চলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। অভিনয় করেন ‘অঙ্গীকার’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘দি ফাদার’, ‘মহানায়ক’, ‘দেবদাস’ প্রভৃতি ছবিতে।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি কটি ছবিও পরিচালনা করেন বুলবুল আহমেদ। তার পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য ছবি হলো ‘ওয়াদা’, ‘ভালো মানুষ’, ‘মহানায়ক’, ‘রাজলক্ষী-শ্রীকান্ত’, ‘আকর্ষণ’, ‘গরম হাওয়া’, ‘কতো যে আপন’ প্রভৃতি ছবিতে।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টিভিনাটকেও বুলবুল আহমেদ অভিনয় চালিয়ে যান। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিকে অভিনয় করে তিনি দারুণ প্রশংসিত হন। নব্বুইয়ের দশকে চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে টিভিনাটকে নিয়মিত হন।
৪৪ বছরের শিল্পী জীবনে বুলবুল আহমেদ প্রায় ৩০০ নাটক আর দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে চার বার তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
পারিবারিক জীবনে বুলবুল আহমেদ ছিলেন বেশ সুখী। স্ত্রী ডেইজি আহমেদ আর তিন সন্তান- ঐন্দ্রিলা, তিলোত্তমা ও ছেলে শুভকে নিয়ে ছিল তার সাজানো সংসার।
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছে বুলবুল আহমেদ ডায়বেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০। মহানয়ক বুলবুল আহমেদকে অন্তিম শয্যায় শায়িত করা হয় বাবা-মায়ের কবরের পাশে আজিমপুর গোরস্তানে।
মৃত্যুর আগে বুলবুল আহমেদ নিজের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে বায়োগ্রাফি লেখার কাজ শুরু করেন। কাজটি তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি। বাবার অসমাপ্ত বায়োগ্রাফি লেখার কাজটি বর্তমানে করছেন তারই সুযোগ্য মেয়ে ঐন্দ্রিলা। ‘একজন মহানায়কের কথা’ শীর্ষক বুলবুল আহমেদের এই বায়োগ্রাফিটি বই আকারে আগামী একুশে বইমেলায় প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে তার।