করোনা টিকা প্রদান: বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

করোনা টিকা প্রদান: বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

গত বৃহস্পতিবারের ২৫ ফেব্রুয়ারি কথা। সকাল সাড়ে ১০টা। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। নারী-পুরুষের আলাদা বুথ। উপচেপড়া ভিড়। শ’ পাঁচেক উপস্থিতি। অসাধারণ ব্যবস্থাপনা। তাড়াহুড়ো নেই।

নেই হই-হুল্লোড়। বিশ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে না কাউকেই। কারো কারো মনে তখনো দ্বিধা, শঙ্কা। পরম মমতায় অভয় দেয়া হচ্ছে তাদের। টেরই পাচ্ছেন না কখন টিকা দেয়া হয়ে গেছে। খুশি মনে ফিরে যাচ্ছেন বাড়ি। এমন দৃশ্য সবক’টি টিকা কেন্দ্রেই। শুরুতে যা ভাবাই যায়নি।

সংশয় ছিল, ছিল নানা প্রশ্ন। বিরোধিতার সুরও ছিল চড়া। কিন্তু সবকিছু কাটিয়ে অবিশ্বাস্য এক ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নাম লিখিয়েছে গৌরবের অর্জনে। করোনা টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে এখন অবস্থান বাংলাদেশের। টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন রীতিমতো যুদ্ধ চলছে তখন উন্নত দুনিয়ার বহুদেশও এখন বাংলাদেশের পেছনে। দৈনিক টিকা দেয়ার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটির নাম বাংলাদেশ।

এই অনন্য অর্জনের পেছনে রয়েছে নেতৃত্ব ও বন্ধুত্বের গল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা ও সাহস এক্ষেত্রে রেখেছে বড় ভূমিকা। বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ক’দিন আগে বিস্তারিত খোলাসা করেছেন এক সাক্ষাৎকারে।

কীভাবে বাংলাদেশ টিকা পেলো? নেপথ্যের অনেক কাহিনী এখনো অজানা। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে একটি চমকপ্রদ গল্প। গত বছর আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎই একটি বড় খবর দেয় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। বিশ্বের ৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করা খ্যাতিমান বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটি।

বেক্সিমকো জানায়, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা বাংলাদেশে নিয়ে আসবে তারা। আর এজন্য চুক্তি হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকোর মধ্যে। বলে রাখা দরকার, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অক্সফোর্ডের টিকা তৈরির কাজ পায় সেরাম।

টিকা পেতে এর আগেই লড়াই শুরু হয়ে গেছে দুনিয়াব্যাপী। বাংলাদেশেও চীনের টিকার ট্রায়াল নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা। সক্রিয় ভূ-রাজনীতি ও টিকা কূটনীতি। এরইমধ্যে তরুণ উদ্যোক্তা সালমান এফ রহমানের একমাত্র পুত্র সায়ান এফ রহমান স্মরণ করলেন তার বন্ধু আদর পুনাওয়ালাকে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরামের প্রধান নির্বাহী। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব তাদের। সায়ান এফ রহমান ও আদর পুনাওয়ালা দু’জনই প্রিন্স অব ওয়েলস প্রতিষ্ঠিত বৃটিশ এশিয়ান ট্রাস্টের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। সায়ান ট্রাস্টের বাংলাদেশ অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের চেয়ারপারসন। আদর ট্রাস্টের ফাউন্ডার্স সার্কেল-এর সদস্য।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতা শেষে বন্ধুর কাছে বাংলাদেশের জন্য টিকা চাইলেন সায়ান এফ রহমান। আলোচনায় উঠে এলো নানা বাধা-বিপত্তি। কিন্তু হাল ছাড়লেন না সায়ান। আলোচনা এগিয়ে যায় নানাভাবে। সেরামের তরফে বলা হয়, অবশ্যই বেক্সিমকোকে এর জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। সায়ান তখন কথা বলেন বাবার সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে কি করা যায়? বেক্সিমকো ফার্মার প্রধান নির্বাহী নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে কথা বলে সালমান এফ রহমান সিদ্ধান্ত নেন বিনিয়োগের। তখনও টিকার কোনো দেখা নেই। টিকা অনুমোদনও পায়নি। এই অবস্থায় ৭০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। ঝুঁকিতো বটেই। প্রাথমিকভাবে বেসরকারি খাতে ১০ লাখ ডোজ টিকা দিতে রাজি হয় সেরাম। সরকার তখনো সামনে আসেনি। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর বেক্সিমকো বাংলাদেশে সেরামের টিকা সরবরাহকারীর একমাত্র পরিবেশক নিযুক্ত হয়। সায়ান এফ রহমান আবার যোগাযোগ স্থাপন করেন আদর পুনাওয়ালার সঙ্গে। বলেন, আমরা তো পরিবেশক হলাম, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কীভাবে টিকা পেতে পারে? সেরামের জবাব তখন একই। বিনিয়োগ করতে হবে। এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে তিন কোটি ডোজ টিকা পেতে পারে বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন সালমান এফ রহমান। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবে সাড়া দেন। বলেন, এখনই ৫০০ কোটি টাকা দিচ্ছি। বাকি ৫০০ কোটি টাকা দেব অনুমোদন পেলে। এতে সম্মত হয় সেরাম। এরপর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয় বাংলাদেশ সরকার, সেরাম ও বেক্সিমকোর মধ্যে। চুক্তি অনুযায়ী মাসে ৫০ লাখ করে ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা দেবে সেরাম। অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করে বাংলাদেশ সরকার। তবে একধরনের অবিশ্বাস ও বিরোধিতা তখনো জারি ছিল। টিকা নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছিলেন অনেকে। বাংলাদেশ বেশি দামে টিকা আনছে- এমন প্রচারণাও দেখা যায়। যদিও চুক্তিতে স্পষ্ট, ভারত সরকার যে দামে টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশও একই দামে পাবে। জানুয়ারির শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আদর পুনাওয়ালার একটি বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক দেখা দেয়। যাতে বলা হয়, শর্ত সাপেক্ষে অক্সফোর্ডের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। শর্তে বলা হয়েছে, ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বা টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আপাতত টিকা রপ্তানি করতে পারবে না সেরাম ইনস্টিটিউট। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি হয়। বাংলাদেশে বিরোধীরাও এ বক্তব্য লুফে নেয়। দ্রুতই সক্রিয় হয়ে ওঠে সরকার ও বেক্সিমকো। যোগাযোগ করা হয় ভারত সরকার ও সেরামের সঙ্গে। তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্ধারিত সময়েই টিকা পাবে বাংলাদেশ। অবশেষে ২৫শে জানুয়ারি টিকার প্রথম চালান আসে। এর আগেই উপহার হিসেবে ভারত সরকার পাঠায় ২০ লাখ ডোজ টিকা। যথাসময়ে টিকা আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী।

৭ই ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান যখন শুরু হয় তখনো একধরনের সংশয় ছিল। কিন্তু দ্রুতই আস্থা বাড়তে থাকে মানুষের। টিকাদান সহসাই পরিণত হয় উৎসবে। শুক্রবার পর্যন্ত যে উৎসবে শামিল হয়েছেন সাড়ে ২৮ লাখ মানুষ। আগ্রহীর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

এই দুর্দিন থাকবে না। একসময় করোনা মুক্ত হবে বিশ্ব। করোনা মুক্ত হবে বাংলাদেশও। আর ইতিহাসে লেখা থাকবে মানুষের নানা প্রচেষ্টা আর উদ্যোগের গল্প। লেখা থাকবে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্জন আর এর নেপথ্যের কাহিনী।

বাংলাদেশ শীর্ষ খবর