বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে শিল্পী তালিকাভুক্তি নিয়ে চলছে স্বজনপ্রীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা। কোনো নীতিমালা আর বাছ-বিছার ছাড়াই বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের তালিকাভুক্তি আর তালিকাভুক্ত কিছু শিল্পীর কয়েক দফা মান-উন্নয়ন (গ্রেডেশন) দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় শিল্পী-গীতিকার-সুরকার ও সংগীত পরিচালকেরা।
বিটিভি সূত্র জানায়, সচরাচর কণ্ঠশিল্পী, নৃত্য পরিচালক এবং গ্রন্থনা ও পাণ্ডুলিপি রচয়িতা বিভাগে তালিকাভুক্তি করা হয় ‘গ’ গ্রেডে। এরপর রয়েছে ‘খ’, ‘ক’, ‘উচ্চ’ ও ‘বিশেষ’ গ্রেড। গীতিকার ও সংগীত পরিচালক বিভাগে তালিকাভুক্তি শুরু হয় ‘খ’ গ্রেড থেকে। এরপর পেরোতে হয় ‘ক’, ‘উচ্চ’ ও ‘বিশেষ’ ধাপ।
এর মধ্যে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক বিভাগে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে বেশি অনিয়ম হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে। এ ছাড়া ‘গ’ থেকে ‘বিশেষ’ গ্রেড পাওয়ার ওপর নির্ভর করে শিল্পীসম্মানীর পরিমাণ ও সামাজিক মর্যাদা। একেকটি গ্রেডের শিল্পী সম্মানীর পার্থক্য প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, গ্রেডেশন বোর্ড না করেই ২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত শিল্পীদের মধ্যে ৪ জনের শ্রেণি উন্নয়ন করা হয়। এর মধ্যে ২জন আছেন যাদের সুর করা ৫টি গানও সর্বশেষ ১২ বছরে চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়নি। কয়েকজন শিল্পীকে ১ বছরের মধ্যেই ‘খ’ শ্রেণি থেকে ‘বিশেষ’ শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। অন্যদিকে নিয়ম অনুযায়ী অনেক জ্যেষ্ঠ শিল্পীকে ৩ বছরেও পরের ধাপে উন্নীত করেনি। এর আগে শিল্পী তালিকাভুক্তি নিয়েও স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বজনপ্রীতির বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘স’ আদ্যাক্ষরের একজন সুরকার ২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সুরকার হিসেবে ‘ক’ থেকে ‘উচ্চ’ গ্রেডে এবং ২০১০ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি ‘উচ্চ’ থেকে বিশেষ গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন। ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর শিল্পী হিসেবে তিনি ‘উচ্চ’ থেকে ‘বিশেষ’ গ্রেডে উন্নীত হন। ‘ক’ আদ্যাক্ষরের একজন সুরকার ২০০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সুরকার হিসেবে ‘খ’ থেকে ‘ক’, ২০১০ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি ‘ক’ থেকে ‘উচ্চ’ এবং ২৫ অক্টোবর ‘বিশেষ’ গ্রেডে উন্নীত হন। তার কোনো গান এখনো টেলিভিশনে প্রচারিত হয়নি।
‘অ’ আদ্যাক্ষরের একজন সুরকার তালিকাভুক্ত হন ২০১০ সালের ১৪ মার্চ। ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি ‘ক’ থেকে ‘উচ্চ’ গ্রেডে চলে যান। এ ব্যক্তি আগের জিএম শামসুদ্দোহা তালুকদারের সময় সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও রিঅডিশনে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। পরে বর্তমান জিএম তাকে তালিকাভুক্ত করেন।
‘ত’ আদ্যাক্ষরের একজন হারমোনিয়ামে অনভিজ্ঞ সুরকার ২০১০ সালের ১৪ মার্চ তালিকাভুক্ত হন, পরের বছরের ২ মে তিনি ‘ক’ এবং ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি ‘উচ্চ’ গ্রেডে চলে যান।
জিএম রফিক উদ্দিন আহমেদের সই করা আলাউদ্দিন তাহের নামের একজন সুরকার/সংগীত পরিচালকের গ্রেডেশনের তিনটি কাগজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘খ’ থেকে ‘ক’, ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর ‘উচ্চ’ এবং ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল ‘বিশেষ’ গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন।
সমসাময়িক একজন শিল্পী বাংলানিউজকে বলেন, জিএম শামসুদ্দোহা তালুকদারের সময় সকল তালিকাভুক্ত শিল্পীদের রিঅডিশন হয়েছিল। এতে উত্তীর্ণ সংগীত পরিচালকদের মধ্যে আলাউদ্দিন তাহের অন্যতম। এর ফল প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর (স্মারক নং: বিটিভি প্রশাসন/৩৮৫/অংশ-১/২৯২৪)। বর্তমান জিএম উত্তীর্ণদের চিঠি দেন ২০১০ সালের ৬ অক্টোবর। প্রশ্ন হচ্ছে কোন যুক্তিতে আলাউদ্দিন তাহেরকে ফল প্রকাশের আগেই গ্রেডেশন দেওয়া হলো।
বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংস্থার সভাপতি আবদুল মান্নান রানা বলেন, শুধু গ্রেডেশনে নয়, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অধিকাংশ সত্যিকারের শিল্পীরাই চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের সংস্কারমূলক কিছু উদ্যোগ চোখে পড়েছে। আশাকরব, কর্তৃপক্ষ সব কিছু আবার ঢেলে সাজাবে।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রে গ্রেডেশনে অনিয়মের কারণে ভালো শিল্পীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার মো. লিপটন বাংলানিউজকে বলেন, এখানে দেখছি যিনি বা যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত একটি বিশেষ চক্রকে তোষামোদ করছে তাদের গ্রেডেশন প্রতিবছর দেওয়া হচ্ছে। সিংহভাগ যোগ্য ব্যক্তিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। অবহেলা করা হচ্ছে। সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা দুঃখজনক বিষয়।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বেতারের মুখ্য সংগীত প্রযোজক আবু তাহের চিশতি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর গানের শিক্ষক মিলন মজুমদারসহ অনেক গুণী শিল্পী এখনো বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম কেন্দ্রে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। অথচ যারা গানের ‘গ’ জানে না তাদেরও সংগীত পরিচালক করা হয়েছে।’
মাত্রাতিরিক্ত শিল্পী তালিকাভুক্ত করার কথা উল্লেখ করে লোকশিল্পী মানস পাল চৌধুরী জানান, ষোল বছরেও পূর্ণাঙ্গ টিভি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে না উঠলেও এখানে ৫ শতাধিক শিল্পী তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন। অন্যরা সুযোগ পায় না। এমন অনেক শিল্পী আছেন ১৬ বছরে ১টি অনুষ্ঠান করারও সুযোগ মেলেনি।
গ্রেডেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বিটিভিতে ৩ বছর পরপর ১ ধাপ থেকে পরের ধাপে উন্নীত হওয়ার আবেদন করেছি। ৩ বছরের আগে কেউ পরের ধাপের কথা চিন্তাও করত না।
বিটিভির তালিকাভুক্ত সংগীত পরিচালক, শিল্পী ও গীতিকার ফরিদ বঙ্গবাসী বলেন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রে প্রথম অডিশন হয় ২০০১ সালে। এরপর কিছু শিল্পী ‘গ’ থেকে বিশেষ গ্রেডে চলে এলেও অনেকে এখনো প্রাথমিক ধাপেই পড়ে রয়েছে। অথচ কেউ কেউ গত ৩ বছরে ৩বার গ্রেডেশন পেয়েছে। বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রে ৩ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ গ্রেড পরিবর্তনের আবেদন করার কথা চিন্তাও করতে পারে না।
তিনি বিটিভি কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তার আশা অভিযানের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে যে উদ্দেশ্যে এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা পূরণ হবে।
শুধু গ্রেডেশন নিয়ে অনিয়ম-স্বজনপ্রীতি নয়, পাশাপাশি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে চলছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, অনুমতি ছাড়া ছুটি ভোগ, প্রচারের তুলনায় অতিরিক্ত অনুষ্ঠান ধারণ, স্বেচ্ছাচারিতা, হয়রানি-খারাপ ব্যবহার, অপেশাদার-ভুঁইফোঁড় লোকজনকে দিয়ে মানহীন অনুষ্ঠান করানো, গুরুত্বহীন সংবাদ প্রচার, উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিল্পী তালিকাভুক্ত করা, ফায়দা নেওয়ার উদ্দেশ্যে শিশুতোষ অনুষ্ঠানে অর্ধশতাধিক খুদেশিল্পী দিয়ে দলীয় পরিবেশনা ইত্যাদি।
বিটিভি সূত্র জানায়, এসব বিষয়ে তদন্ত করতে চলতি বছরের এপ্রিলে বিটিভির অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) রবিউল রেজা সিদ্দিকী চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সম্প্রতি বিটিভির নতুন মহাপরিচালক ম. হামিদও চট্টগ্রাম কেন্দ্র ঘুরে গেছেন। গত বছরের ২৪ নভেম্বর বিটিভির উপ-পরিচালক (অর্থ) মো. জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দলও তদন্ত করে যান।
১৩ জুন বিটিভির সহকারী পরিচালক হেলাল কবিরের সই করা এক চিঠিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত অনুষ্ঠান সহযোগী শাহনেওয়াজ সোহাগ ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. লিটনের নিয়োগ বাতিল ও কণ্ঠশিল্পী সুজিত রায়কে অনুষ্ঠান থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। যা ১৮ জুন থেকে কার্যকর করা নির্দেশ ছিল। একই সাথে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক রফিক উদ্দিন আহমেদ ও উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আ ন ম মনছুর আহমেদ কারণ দর্শাতে (শোকজ) বলা হয়।
কাছের লোকজনকে ২০০৯-১১ সালের মধ্যে তিনবার গ্রেডেশন দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেসব গ্রেডেশন দেওয়া হয়েছে সবই ঢাকা থেকে অনুমোদন হয়ে আসছে। কোয়ালিটি থাকলে তো অবশ্যই গ্রেডেশন হবে। আপনি ঢাকার সঙ্গে কথা বলুন।’
কিন্তু ঢাকায় তো অনুমোদন চাওয়া হয়েছে আপনার মাধ্যমে এবং গ্রেডেশনের পর শিল্পীকে দেওয়া চিঠিতে তো আপনার সই রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব ঢাকার নির্দেশে হয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘শিল্পীদের শ্রেণিমান ১ ধাপ থেকে পরের ধাপে উন্নীত হওয়ার (গ্রেডেশন) জন্য ন্যূনতম ৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়। তবে এক্সট্রা অর্ডিনারি কোয়ালিটি থাকলে বিশেষ বিবেচনায় ১ থেকে দেড় বছর পরে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেওয়া হবে।’
অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় সচেতন শিল্পীরা চট্টগ্রাম কেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বেশ কিছু কাটিং আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। যতদূর জেনেছি কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পর থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা তদন্ত এবং কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগামী দিনে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাকির হোসেন সড়কসংলগ্ন ফয়’স লেক এলাকায় ১০ একর জায়গার ওপর নির্মিত বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। ফরাসি সরকারের অর্থায়নে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ কেন্দ্র নির্মিত হয়।