খসড়া আইন বেপরোয়া যান চালিয়ে মানুষ হত্যা করলে ৫ বছর কারাদণ্ড

খসড়া আইন বেপরোয়া যান চালিয়ে মানুষ হত্যা করলে ৫ বছর কারাদণ্ড

বেপরোয়া যান চালিয়ে মানুষ হত্যা করলে চালকের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে সড়ক পরিবহন ও চলাচল আইন-২০১২ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া দোষী চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স তিন বছরের জন্য রহিতকরণ করা হবে, যা সারা জীবনের জন্যও হতে পারে।

আইন বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য সরকারি একটি কর্তৃপক্ষ গঠনসহ বেশ কিছু বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। খসড়ায় ড্রাইভারের বয়স, ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখার বাধা-নিষেধ, লাইসেন্সের জন্য অযোগ্য ব্যক্তি, লাইসেন্স থেকে বঞ্চিতকরণ, লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা, লাইসেন্স হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের তালিকাসহ ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা রাখা হয়েছে।

ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের (ডিটিসিবি) ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেইস) প্রজেক্টের আওতায় আইনটির বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (www.moc.gov.bd) দেওয়া হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্টেক-হোল্ডার বা জনসাধারণ ৩১ জুলাই পর্যন্ত (www.moc.gov.bd/act2012.php) লিংকের মাধ্যমে অনলাইনে মতামত দিতে পারবেন। এরইমধ্যে ওয়েবসাইটে মতামত দেওয়া শুরু হয়েছে।

তবে আইনের খসড়া এখনও হাতে পাননি সড়ক পরিবহন নেতারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আইনের খসড়া না দেখে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

খসড়ায় নয়টি কারণে যান চালিয়ে মানুষ হত্যা করলে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এগুলো হলো: লাইসেন্সহীন চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, মোবাইল টেলিফোন ব্যবহার; ইয়ারফোন পরিহিত অবস্থায়; বেপরোয়া বা বিপজ্জনকভাবে যান চালানো অবস্থায়; প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ; অবহেলা; মাদকাসক্ত; ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিশক্তি বা অন্য কোনো রোগে অনুপযুক্ত অবস্থায় দুর্ঘটনা।

এছাড়া রয়েছে অর্থদণ্ডসহ নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং কমপক্ষে তিন বছরের জন্য লাইসেন্স বাতিল, যা সারা জীবনকাল পর্যন্ত হতে পারে।

ওই নয় কারণে মোটরযান চালিয়ে কোনো ব্যক্তিকে গুরুতর আহত করলে অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা আহত ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই অপরাধে কমপক্ষে এক বছরের জন্য লাইসেন্স বাতিল করা হবে, যা তিন বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে পারে।

আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, লাইসেন্সধারী ব্যক্তি যান দিয়ে মানুষ হত্যা; বেপরোয়া যান চালানো; পুলিশ কর্মকর্তাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা; মাদকাসক্ত অবস্থায় যান চালানোয় মৃত্যু বা অন্যের জখম করলে শাস্তি পেতে হবে। উল্লেখিত কোন অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী হলে বা আদালত দোষী সাব্যস্ত করলে কর্র্তৃপক্ষ তার শুনানীর সুযোগ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স রহিত করতে পারবে।

এতে বলা হয়, ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ব্যক্তি অপরাধী বা মাতাল; পরীক্ষার সময় তার শরীরে মাত্রাতিরিক্ত মদ; যানবাহন চলাচল সম্পর্কিত প্রবিধানে গুরুতর অপরাধী এবং বেপরোয়া মোটরযান চালকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক রহিতকরণ বা ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং ত্রিশ বা তদুর্ধ্ব ইউনিটের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

খসড়া আইনের ২২টি অধ্যায়ে এমন বিভিন্ন প্রকার ৪৩৪টি অপরাধ কোডে এই আইনের অধীনে অপরাধের বিধান স¤¦লিত ১৯৮টি ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

পরিবহন ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ, সুযোগ-সুবিধার সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ; মোটরচালিত ও অ-মোটর চালিত যানবাহন নির্মাণ, পরিদর্শন, রক্ষণাবেক্ষণ; পরিবহন ও চলাচলের সুবিধার জন্য ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ এবং সড়ক-জনপথে চলাচলকারী ও অন্যান্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ আইনের উদ্দেশ্য।

আইনটি মতামত গ্রহণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সংশোধন-সংযোজনের পর সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ ও কার্যকর হবে।

প্রথম অধ্যায়ে দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন যানবাহন, ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থা, সড়কের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে সড়ক পরিবহন প্রশাসনের দায়িত্ব বণ্টনে বলা হয়েছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগস্থ সরকার বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সড়ক চলাচল ব্যবস্থার জন্য সার্বিকভাবে দায়ী থাকবে। আইনের উদ্দেশ্য পূরণে সরকার যে কোন প্রতিষ্ঠানকে সরকারি বলে ঘোষণা করতে পারবে।

আইনে একটি সরকারি অথরিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। চেয়ারম্যান, ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সদস্য-সচিবসহ পাঁচজন স্থায়ী এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংশ্লি¬ষ্ট বিষয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনধিক ছয়জনসহ ১১ সদস্য সমন্বয়ে অথরিটি গঠিত হবে। সড়ক বিভাগের সচিব পদাধিকার বলে অথরিটির চেয়ারম্যান হবেন।

অথরিটির কার্যাবলী: সড়কের পরিকল্পনা, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ; পথচারী হাঁটার পথ, স্টপেজ বা যাত্রী ছাউনী, টার্মিনালের পরিকল্পনা, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষন; ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; সড়ক পরিবহন ও চলাচল ব্যবস্থাপনার; লাইসেন্স তদারকি; যানবাহনের মান, যানবাহন মেরামত ও পরীক্ষণ কেন্দ্রের নিবন্ধন; প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন; পরিবহন সার্ভিসের সমন্বয় সাধন; পরিবহন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে গবেষণা; ব্যাংক হিসাব প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ; সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ইত্যাদি।

সিটি কর্পোরেশন বা পৌর মেয়র বা কোন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাকে অথরিটি দায়িত্ব প্রয়োগ ও পালনের ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে। আইনে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ও মোটরযানের অপসারণ বিষয়ে সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়ে ১৮ বছর বয়স হলে সকল শর্ত পূরণ করে চালকের লাইসেন্স প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আবেদনকারীকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলা বা ইংরেজি পড়ালেখা ও বোঝার ক্ষমতা, সরকারি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কৌশল এবং সাধারণ শব্দ সংকেত শোনার ক্ষমতা, সড়ক বিধি এবং নিরাপদ যান চালানোর নিয়মাবলী সম্পর্কে জানতে হবে।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতার মেয়াদ অপেশাদার ক্ষেত্রে ১০ বছর এবং পেশাদারদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর। এছাড়া আদালত বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ২৭৯, ৩৩৮(ক) বা ৩০৪(খ) এর অধীন সংঘটিত কোন অপরাধ বা এই আইনের কোন ধারার অধীন দণ্ডনীয় হলে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে। তবে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।

লাইসেন্স ছাড়া কোনো ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। লাল বাতির বিরুদ্ধে যান চালানো, পথচারী পারাপারের স্থানে যানবাহন অতিক্রম, প্রধান সড়কে বিরতিহীন যান চালানো ও নির্দেশিত গতিসীমা অতিক্রম, একমুখী সড়কে বিপরীত দিকে যান চালালে ড্রাইভিং লাইসেন্স হতে বঞ্চিতকরণ করা হবে।

চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রমিকদের লাইসেন্স ও গণসার্ভিস যানবাহন শ্রমিকদের জন্য বৃত্তিমূলক লাইসেন্স প্রদানের বিভিন্ন শর্ত; পঞ্চম অধ্যায়ে মোটরযানের মালিকানার জন্য প্রাধিকারদান এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে মোটরযান নিবন্ধন সংক্রান্ত বিধানের কথা উল্লেখ রয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়, কর্মঘণ্টার অধিক সময় নিয়েজিত থাকলে মোটরযানে কমপক্ষে দুইজন চালক নিয়োগ; মহিলা, বয়স্ক বা প্রতিবদ্ধী যাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষন; মোটরযানে প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স ও অগ্নি নির্বাপক বহন এবং গণপরিবহনে অভিযোগ বই সংরক্ষন করতে হবে।

শ্রমিকদের কমপক্ষে আধাঘণ্টার বিরতি ছাড়া পাঁচ ঘণ্টার অধিক বা একদিনে আট ঘণ্টার অধিক বা সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার অধিক কাজ করানো যাবে না।

অষ্টম অধ্যায়ে গণপরিবহন সার্ভিস পরিচালনায় লাইসেন্স, ভাড়া, জনসাধারণের দাঁড়াবার স্থানের কথা বলা হয়েছে। নবম অধ্যায়ে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ের রয়েছে কথা।

দশম অধ্যায়ে অনিরাপদ অবস্থায় মোটরযান ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ধোঁয়া নির্গতের বিধি-নিষেধ এবং একাদশ অধ্যায়ে মোটরযান প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীদের কিছু বিধিবিধানের উল্লেখ রয়েছে।

সড়ক ও মহাসড়ক ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর জন্য সড়ক কোড প্রণয়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়ে। এতে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত রাস্তা ব্যবহার, সেতুর উপর যানবাহনের বিধি-নিষেধ, গাড়ির বাতি প্রজ্জলন, পথচারী পারপার, সংরক্ষিত সড়কে বিজ্ঞাপন বা গণবিজ্ঞপ্তির উদ্দেশ্যে স্থাপনা তৈরির ওপর বিধি-নিষেধ।

ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বলা হয়, চলাচলের সময় মোবাইল-টেলিফোন ও ইয়ারফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ; মিছিল-শোভাযাত্রার শর্ত; চালক ও আরোহনকারীর সিট বেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক; চালকের এক বছরের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত না হলে মোটরসাইকেল চালাবেন না। আর একজনের অধিক বহন করা যাবে না।

ফুটপাতের ওপর চলাচলের নিয়মাবলী উল্লেখ করা হয়েছে চর্তুদশ অধ্যায়ে। এতে রয়েছে বাই-সাইকেলে নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিকে বহন করার কথা। এছাড়া অনুমোদন ছাড়া সড়কে বাই-সাইকেল রেস নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পঞ্চদশ অধ্যায়ে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দুর্ঘটনা হ্রাসে নীতিমালা প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণে পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল-এনআরএসসি/জাসনিকা প্রতিষ্ঠা, যার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শাখা থাকবে। এই কাউন্সিল সড়ক নিরাপত্তা কাজের সমন্বয়ক ও পরিকল্পনার কাজ করবে।

মোটরযানের ওপর করারোপ, কর কর্মকর্তা নিয়োগ, কর পরিশোধের দায়-দায়িত্বের কথা রয়েছে ষষ্ঠদশ অধ্যায়ে; সপ্তদশ অধ্যায়ে মোটরযান অপরাধ নিরোধ ব্যবস্থা, অননুমোদিত যান ব্যবহারের বিধিনিষেধ এবং অষ্টাদশ অধ্যায়ে রয়েছে অস্থায়ীভাবে দেশ ত্যাগকারী বা আগমণকারী মোটরযানের ব্যবহারের নিয়ম।

উনবিংশ অধ্যায়ে দুর্ঘটনার জন্য তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকির বিরুদ্ধে মোটরযান বীমা এবং বীমা দাবি নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইবুন্যাল গঠনের কথা বলা হয়েছে।

বিংশদশ অধ্যায়ে সড়ক পরিবহন সুবিধা ও সেবার কার্যকরী পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ এবং সড়ক পরিবহন ও চলাচল এবং সুবিধা ও সেবার সঙ্গে জড়িত অথরিটি এবং অন্যান্য সংস্থাকে উপদেশ, নির্দেশনা ও কারিগরি সহায়তা এবং দ্রুত ট্রানজিট ব্যবস্থাসহ সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থার জন্য সড়ক পরিবহন ইন্সটিটিউট-আইআরটি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।

অপরাধ ও দণ্ড প্রদান, শাস্তির বিধান, সাক্ষ্য সম্পর্কিত বিধানের উল্লেখ রয়েছে একবিংশ অধ্যায়ে। ২২তম অধ্যায়ে মোটর ভেকেল অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩ (অর্ডিন্যান্স নং এলভি অব ১৯৮৩) এবং মোটর ভেকেল ট্যাক্স অ্যাক্ট-১৯৩২ (বেন অ্যাক্ট এল অব ১৯৩১) রহিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে উক্ত অর্ডিন্যান্স ও অ্যাক্টের অধীন জারীকৃত কোন প্রজ্ঞাপন, বিধি বা নোটিশ মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।

বাংলাদেশ