বিদেশি ব্যাংকগুলো শুধু মুনাফা ছাড়া কিছু বোঝে না। আর এজন্য তারা অনেক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না দেশে কার্যরত নয়টি বিদেশি ব্যাংককে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব নির্দেশ দিচ্ছে তা অবজ্ঞা করে ব্যাংকগুলো। এক কথায়, অনেকটা অস্বচ্ছ ব্যাংকিং করে তারা শুধু মুনাফা করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকতা জানান, কোনো দেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলে সে দেশের প্রতি কিছু দায়িত্ব থাকে। তবে সেটি কেবল করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) আর কর দেওয়া নয়। এর বাইরে ব্যবসায়িকভাবে ঐ রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকতে হয়।
তারা বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব বিদেশি ব্যাংক ব্যবসা করেছে তাদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বড় কোনো সিদ্ধান্ত তারা অনেক সময় মানতে চান না। এটা দুঃখজনক।’
সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ৯টি বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, এইচএসবিসি, ব্যাংক আল ফালাহ লিমিটেড, কমার্সিয়াল ব্যাংক অব সিলোন, সিটি ব্যাংক এনএ, হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও উরি ব্যাংক।
সূত্র বলছে, বিদায়ী অর্থবছরের ব্যাংকিং খাতে বড় একটি আলোচনা ছিল তারল্য সংকট। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেনি। এর বড় ভুক্তভোগী ছিল নির্বাচিত প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংকগুলো। সরকারি সিকিউরিটিজ (ট্রেজারি বন্ড ও ট্রেজারি বিল) কিনে তারা সরকারকে ঋণ দেয়। বর্তমানে এমন ১২টি ব্যাংক এবং তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এখানে একটিও বিদেশি ব্যাংক নেই। মুনাফা কমে যাবে চিন্তা করে তারা প্রাইমারি ডিলার হচ্ছে না।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর এসকে সূর চৌধুরি বলেন, ‘বিদেশি ব্যাংকগুলোকে পিডি হবার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকবার লিখিতভাবে অনুরোধ করেছে। কিন্তু তারা হতে চায় না। তবে জোর করে করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে জোর তাদের পিডি করতে পারবে।’
দীর্ঘদিনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছরের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন চরম তারল্য সংকটে পড়ে। বিশেষ করে পিডি ব্যাংকগুলো। তখন এসব ব্যাংক কল মার্কেটে যান দ্রুত টাকার যোগান নিতে। ৯টি বিদেশি ব্যাংক বছর জুড়েই অতিরিক্ত তারল্য থাকার কারণে কল মার্কেটে টাকা ধার দিত। এতে বেশি মুনাফার সুযোগ থাকে।
জানা গেছে, সরকারকে ঋণ সহায়তা নিতে যেসব বন্ড বা বিল অর্থবাজারে ছাড়ে তার বিপরীতে ৭ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করে সরকার। আর ঋণের মেয়াদ হয় ৫ থেকে ২০ বছর। তাই বিদেশে ব্যাংকগুলো পিডি হয়ে এসব নিতে চায় না। তারা কল মার্কেটে অংশ নিয়ে বেশি মুনাফা করতে পারে। সেখানে বিনিয়োগ করলে তারা ১৬ থেকে ২১ শতাংশ হারে মুনাফা হয়।
সূত্র বলছে, সরকারকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭৫টি তারল্য সহায়তা দেয় পিডিদের। এক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংকগুলোর দাবি, ঋণের পূর্ণ মেয়াদে তাদের তারল্য সহায়তা দিতে হবে।
শুধু যে কল মার্কেটে অংশ নিয়ে বেশি মুনাফার পেছনে এসব বিদেশি ব্যাংক ছুটছে তাই নয়। কৃষি ঋণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) ঋণ দিতেও আগ্রহী নয় এসব ভিনদেশি ব্যাংক। অথচ প্রতি বছরই তাদের মুনাফা বাড়ছে। হাজারো কোটি টাকা মুনাফা করে নিয়ে যাচ্ছে তারা।
সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদায়ী অর্থবছরে দেশীয় ৩০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ দিতে বলে। সেখানে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। একই চিত্র এসএমই ঋণের ক্ষেত্রেও। অথচ তথাকথিত করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) নাম নিয়ে ব্যাংকগুলো দায়িত্ব পালনের কথা প্রচার করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকতা বলেন, ‘আমাদের দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোকে মুনাফা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। তারা শুধু মুনাফার পেছনেই দৌড়ায়।’