প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এমনকি এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনের ‘গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক দুর্নীতির’ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরেন দিলীপ সরকার।
তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ তুলে ধরে গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও করা হয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে কথা বলতে রাষ্ট্রপতির সময়ও প্রার্থণা করা হয়েছে।’
রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখিত অসদাচরণের মধ্যে রয়েছে- একাদশ জাতীয় সংসদ, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ।
আর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে— নির্বাচন কমিশনারদের বিশেষ বক্তা হিসেবে দুই কোটি টাকা গ্রহণ, নিয়োগের নামে চার কোটি আট লাখ টাকার দুর্নীতি, নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনটি করে গাড়ি ব্যবহার এবং ইভিএম কেনায় অনিয়ম।
চিঠিতে যারা সই করেছেন:
চিঠিতে সই করেছেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অবসরপাপ্ত মহা হিসাব-নিরীক্ষক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড. আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি. আর. আবরার, আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিকাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণে পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। যারা সাংবিধানিক পদে আছেন তাদের বিরুদ্ধে দুদক বা পুলিশ তদন্ত করতে পারে না। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সেটা করতে পারে। আর একমাত্র রাষ্ট্রপতিই এ নির্দেশ দিতে পারেন। আমরা রাষ্ট্রপতিকে এসব বিষয় জানিয়েছি। পরবর্তীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন কোনও নির্বাচন হয় না, হয় নির্বাচন নির্বাচন খেলা। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে আমরা খারাপ নির্বাচন বলি। এখন নির্বাচনগুলো সে রকমই হচ্ছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে আমরা গভীর সংকটে আছি। আশা করি মহামান্য রাষ্ট্রপতি জাতির স্বার্থে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে, তা আগে কখনও দেখা য়ায়নি। তারা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করবো। আমরা আশা করবো, যতদিন সিদ্ধান্ত না হয় ততদিন সিইসি ও কমিশনারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন বা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন।’
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করবেন বলে যে আশা করা হচ্ছে তা কতটুকু বাস্তবসম্মত- এবষিয়ে শাহদীন মালিক বলেন, ‘অতীতেও কিছু খারাপ নির্বাচন হয়েছে। ‘৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। এখন যেগুলো হচ্ছে সেগুলোও এরকম। এ ধরনের নির্বাচন কোনও ব্যক্তির কাছে কাম্য নয়। আমরা মনে করি দেশে গভীর সংকট রয়েছে। গভীর সংকটে পড়লে জাতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির দিকে তাকায়। তার একটি নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা আশাবাদী রাষ্ট্রপতি এ অভিযোগের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেবেন।’
আর্থিক অনিয়মের তিন বছর পরে কেন এই অভিযোগ— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। দুই-তিনটা অভিযোগ দিয়ে আমরা এটা করতে চাইনি। অপেক্ষা করেছিলাম, দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের বিষয়ে অভিযোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। গুরুতর অসদাচরণ, দুর্নীতি যথেষ্ট হয়েছে। তাদের অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়ে গেছে।’
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফলে তাদের এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো।’
রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কিনা সন্দেহ আছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে।’
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘জানি হয়তো আলটিমেটলি কিছু হবে না। কিন্তু তাগিদ দিলাম। সংবিধানে আছে।’