আশিয়ান সিটির টোপ গিলে একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক রিয়াজ এখন অন্যতম প্রতারনাকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ভূমি ব্যবসায়, দখলবাজ ও প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠান আশিয়ানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ শুরু করে, পরে পরিচালক এবং বর্তমানে প্রধান নির্বাহীর পদটি রিয়াজের দখলে। এদিকে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে আশিয়ানের রমরমা ভূমি ব্যবসা অব্যাহত রয়েছে। আর এভাবেই চলচ্চিত্র নায়ক রিয়াজ বাস্তবের খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
ঢাকাই চলচ্চিত্রের নব্বুই দশকের সেরা নায়ক সালমান শাহ পরবর্তী সময়ের অন্যতম সফল নায়ক রিয়াজ। চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। ধারণা করা হয়, শাকিব খানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেছেন তিনি। তবে ভূমি ব্যবসায় প্রতারণাকারী হিসেবে চিহ্নিত আশিয়ানের সঙ্গে থেকে ব্যাপক দূর্নাম কুড়িয়েছেন রিয়াজ।
চলচ্চিত্র থেকে বর্তমানে নির্বাসিত নায়ক রিয়াজের পুরো নাম রিয়াজ আহমেদ সিদ্দীকি। চাচাতো বোন অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে ১৯৯৪ সালে এফডিসি ঘুরতে এসে চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে যান। এয়ারফোর্স একাডেমীতে পড়াশোনা শেষ করে রিয়াজ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পাইলট হিসেবে। শৃংখলা বিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমান বাহিনী থেকে বহিস্কৃত হওয়ার পর আশ্রয় নেন চলচ্চিত্রে। ১৯৯৫ সালে দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘বাংলার নায়ক’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন। তবে সাফল্য পান পরের বছর মুক্তি পাওয়া মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ ছবির মাধ্যমে। .
রিয়াজ প্রায় এক দশক দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্রে অভিনয় চালিয়ে যান। অভিনয় জীবনে তিনবার তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘পৃথিবী তোমার আমার’, ‘ভালোবাসি তোমাকে’, ‘প্রেমের তাজমহল’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘রংনাম্বার’, ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হৃদয়ের কথা’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ প্রভৃতি। শীর্ষ নায়িকা শাবনূর ও পূর্ণিমার সঙ্গে গড়ে তোলা রিয়াজের জুটি জনপ্রিয়তা পায়। দুই নায়িকা সঙ্গেই বিভিন্ন সময় নানা স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়ে রিয়াজ বিয়ে করেন ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ফটোসুন্দরী ও মডেল মুশফিকা তিনাকে।
বিয়ে করার কয়েক মাসের মধ্যেই রিয়াজ অস্বাভাবিক মুটিয়ে যান। এ সময় ঢাকাই চলচ্চিত্রে উত্থান হয় শাকিব খানের। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি থেকে চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হয়ে পড়েন তিনি। রিয়াজের ছবিগুলো একের পর এক ব্যবসায়িকভাবে মুখ থুবড়ে পড়ায় চলচ্চিত্র থেকে অনেকটা অভিমান নিয়েই তিনি নির্বাসনে চলে যান।
চলচ্চিত্র থেকে গুটিয়ে নিয়ে নায়ক রিয়াজ ‘ইয়েস কর্পোরেশন’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তথাকথিত ‘যৌবন বর্ধ¦ক’ পানীয় শরবতে-ওয়ান্ডারসহ আরো কিছু ফুড প্রডাক্ট বাজারজাত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। এসময়ই তিনি যুক্ত হন বিতর্কিত আবাসিক প্রকল্প ‘আশিয়ান সিটি’-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।
একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সচরাচর প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের বিজ্ঞাপনের মডেল হন কিংবা বিভিন্ন কনফারেন্স বা পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেন। আশিয়ান সিটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে রিয়াজ এতে সীমিত থাকেন নি। তিনি সরাসরি প্রতিষ্ঠানের বিপনন কার্যক্রম নেমে পড়েন। শুরু করেন আশিয়ান সিটির হয়ে জমির দালালি। এমন কি তার বিরুদ্ধে আশিয়ান সিটির পক্ষে স্থানীয় গরীব মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নাম মাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার অভিযোগও আছে।
চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে ফেসভ্যালু থাকায় প্রবাসী অনেক গ্রাহকই রিয়াজের মাধ্যমে জমি কেনার টাকা দিয়ে অদ্যবধি মালিকানা পান নি। গত কয়েক বছর ধরে রিয়াজকে প্রবাসী বাংলাদেশী অধ্যুষিত দেশগুলোতে সফর করতে দেখা যায়। তিনি সরাসরি প্রবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে তাদের চমকপ্রদ প্রলোভন দেখিয়ে আশিয়ান সিটির জমি কিনতে উৎসাহিত করেন। তার মাধ্যমে জমি কিনলে বিশেষ ছাড় পাওয়া যাবে জানিয়ে প্রবাসীদের প্রলুব্ধও করে থাকেন। বিনিময়ে দালালি বাবদ আশিয়ান সিটির কাছ থেকে তিনি পান মোটা অংকের টাকা। এমনকি মক্কাশরীফে হজ্জ্ব পালন করতে গিয়েও তিনি জমির দালালি করেছেন বলে জানা গেছে।
রিয়াজের মাধ্যমে যারা আশিয়ান সিটির গ্রাহক হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই মালিকানা দূরে থাক, পুরো টাকা পরিশোধের পরও কোনো কাগজপত্র পান নি বলে অভিযোগ আছে। তারকাখ্যাতি থাকায় জমি দখল, ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যান্য অনৈতিক ও অবৈধ কর্মকান্ডে প্রশাসনকে প্রভাবিত করা ও ব্যবহার করার কাজটিও রিয়াজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন। এভাবেই চলচ্চিত্রের নায়ক রিয়াজ বাস্তবের খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
এই নীতি বহির্ভূত কর্মকান্ডের পুরস্কারও অবশ্য আশিয়ান সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে দিয়েছে। ২০১১ সালের এপ্রিলে রিয়াজকে আশিয়ান গ্রুপের পরিচালক করা হয়। এখানেই শেষ নয়, ভূমি নিয়ে প্রতারণার কাজে দক্ষতা ও অভিনব কৌশলের কারণে রিয়াজকে বর্তমানে আশিয়ান সিটির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
রিয়াজের সঙ্গে সম্প্রতি যোগাযোগ করে আশিয়ান গ্রুপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথমেই বলেন, ‘বাসস্থান হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করছে আশিয়ান গ্রুপ।’
আশিয়ান সিটিতে নিজের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে রিয়াজ বলেন, ‘আমি আশিয়ান সিটির জন্মলগ্ন থেকেই যুক্ত। প্রথমে এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলাম। এরপর যখন চলচ্চিত্রে সময় কমিয়ে দেওয়া শুরু করে পাশাপাশি ব্যবসার কথা ভাবলাম তখনই আশিয়ান সিটি থেকে প্রস্তাব পেলাম এবং রাজি হয়ে গেলাম। এভাবেই আশিয়ান সিটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যেহেতু ব্যবসায় নতুন, তাই অন্য ব্যবসা আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আশিয়ান সিটি সম্পর্কে তো আমার সব কিছুই জানা। অতএব ঝুঁকির কোনো ব্যাপার নেই, এভাবেই শুরু।’
‘অনেকের অভিযোগ টাকা নিয়ে আশিয়ান সিটি জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না’ এ প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ বলেন, ‘এটা বানোয়াট কথা। কিস্তির মাধ্যমে ক্রেতারা আমাদের জমি কিনছে। একটা-দুটা কিস্তি দেওয়ার পর নিশ্চয়ই জমির মালিকানা আমরা কাউকে দিয়ে দিতে পারি না। দেখা যায়, অনেকে নানা কারণে ৬ মাস বা ১ বছর কিস্তি দেন না। কেউ টাকা পরিশোধ না করলে আমরা এই প্রজেক্ট তার নামে বাতিল করে অন্য কোথাও বিক্রি করি। তবে যারা কিছু টাকা দিয়ে ফেরত চায়, আমরা তার টাকা যথাসময়ে ফেরত দিয়ে দিই।’
এ পর্যন্ত কতজন গ্রাহককে আশিয়ান গ্রুপের পক্ষ প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ছয় হাজার গ্রাহক আছে। এরমধ্যে ৫ থেকে ৬শ’ জনকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রেতাদের টাকা পরিশোধ হলে বাকি প্লটগুলোও বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
রাজউকের কাছে আশিয়ানের বিরুদ্ধে তিনশ’র বেশি অভিযোগ আছে। এরকম কয়েকটি অভিযোগের কথা রিয়াজের কাছে তুলে ধরলে তিনি তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সামনে শবে-বরাত। এ মুহূর্তে ধর্ম-কর্ম নিয়ে একটু ব্যস্ত আছি। শবে বরাতের পরে আসেন। সব বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলবো। এ মুহুর্তে কথা বাড়াতে চাচ্ছি না।’