আগের কমিশনের তৈরি করা খসড়া থেকে সরে এসে কাট-ছাটের মাধ্যমে ‘ভোটার তালিকা বিধিমালা-২০১২’ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন(ইসি)।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য কমিশনের সভায় এ খসড়া বিধিমালা অনুমোদন করে তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
খসড়া বিধিমালায় প্রতি বছর ২ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও বিগত নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন করে প্রতি বছর ২ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই বাক্যের পরিবর্তে ‘কমিশন যখন সময় নির্ধারণ করবে’- প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করেছিল।
ভোটার তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের সংশোধন ও আধুনিকীকরণকল্পে প্রণীত আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কম্পিউটারে ডাটাবেজ সংরক্ষিত বিদ্যমান সকল ভোটার তালিকা, প্রতি বছর ২ থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে হালনাগাদ করতে হবে।’ আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা চলমান প্রক্রিয়া হলেও গত নির্বাচন কমিশন তা করেনি।
এ প্রসঙ্গে বিগত কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রতি বছর মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে এ কাজ করার বিদ্যমান আইনটি বাস্তবসম্মত নয়। এছাড়া আইনে হালনাগাদের সময় নির্দিষ্ট করে রাখার ফলে প্রতিদিন গড়ে দেশের প্রায় চার হাজার নাগরিকের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেও তাদের ভোটার হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
এ জটিলতা নিরসনে সংশোধিত আইন ও বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিগত কমিশন। আইন সংশোধন করে প্রতি বছর ২ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই বাক্যের পরিবর্তে ‘কমিশন যখন সময় নির্ধারণ করবে’-প্রতিস্থাপন করা হয়।
কিন্তু আইন সংশোধনে আগের ইসির প্রস্তাব আমলে নেয়নি সরকার। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামতের জন্য বিগত ইসির প্রস্তাবগুলো বর্তমান কমিশনের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। তবে বর্তমান কমিশন ভোটার তালিকা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে না।
প্রতি বছর ভোটার তালিকা হালনাগাদ না করার বিষয়ে বিগত কমিশনের নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন থাকার কারণে ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হালনাগাদের কাজটি করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য হালনাগাদ কার্যক্রম ইসির সুবিধাজনক সময়ে করার বিধান রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতি বছর হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করা স্বল্প জনবল দিয়ে সম্ভব ছিল না। কিন্তু সরকার এ সংক্রান্ত আইন এখনো প্রণয়ন করেনি।’’
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নির্বাচনী আইন সংস্কারের প্রস্তাবের বিষয়ে বর্তমান কমিশনের মতামত চেয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। এ জন্য মন্ত্রণালয় ওই সংস্কার প্রস্তাবের নথি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ফেরত পাঠিয়েছে। কমিশনও সেগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওই সংস্কার প্রস্তাবে ভোটার তালিকা আইনও রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, প্রস্তাব পর্যালোচনা করে আবার মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে সময় লাগবে। কিন্তু ভোটার তালিকা-সংক্রান্ত আইন সংশোধনে বিলম্ব হলে চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদ নিয়ে আইনগতভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সচিব শহিদুল হকের দফতরে একাধিকবার টেলিফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ এ সম্পর্কে বলেন, ‘‘আইন পাস করবে জাতীয় সংসদ। আইন পাস হওয়ার পরই বিধিমালা তৈরির প্রশ্ন আসে। কিন্তু আগের কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবে আইন ও বিধিমালা একসঙ্গে পাঠানো হয়েছে। সে জন্যই মন্ত্রণালয় নথিটি ফেরত পাঠিয়েছে। তাই কমিশন আপাতত বিধিমালাগুলো বাদ দিয়ে শুধু আইনগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে তা আবার মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।’’
কমিশন সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংস্কার প্রস্তাবের নথি ফেরত পাঠায়। এরপর কমিশন প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন গত ২৫ এপ্রিল কমিশনের বৈঠকে আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়। তবে আলোচনা হয়নি। পর্যালোচনায় আগের কমিশনের প্রস্তাবিত আইনের কিছু অংশ বাদ যেতে পারে এবং নতুন কিছু যোগ হতে পারে।
সাবেক সিইসি শামসুল হুদা এবং দুই কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসেন ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যাওয়ার আগে এ প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। এতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ভোটার তালিকা আইন ও বিধিমালা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন ও বিধিমালা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ও বিধিমালায় কিছু সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
সিইসি ও কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন করার প্রস্তাবও এতে করা হয়েছে। কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছিল। তবে ওই সংলাপে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতসহ সমমনা আটটি দল অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ সংলাপে অংশ নিলেও মতামত দেয়নি। দলটি দ্বিতীয় দফা সংলাপে বসে মতামত দেবে বলে জানালেও শেষ পর্যন্ত যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সিইসি শামসুল হুদা বলেন, ‘‘প্রস্তাব ফেরত দিলেও এতে সমস্যার কিছু নেই। নতুন কমিশন এ বিষয়ে মতামত দিতেই পারে। তবে আমাদের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই। কারণ, কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তাবটি তৈরি করেছে।’’
কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, ভোটার তালিকা আইন সংশোধনে বিলম্ব হলে ভোটার তালিকা হালনাগাদের খসড়া যথাসময়ে তৈরি করা সম্ভব হবে না। বিষয়টি একই সঙ্গে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ মেয়াদোত্তীর্ণ অন্যান্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে ব্যাহত করতে পারে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কমিশন ১০ মার্চ থেকে সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা শুরু করেছে। এতে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ বছর হবে, তাদের ভোটার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইনে যাদের বয়স ১৮ বছর হয়েছে, কেবল তাদেরই ভোটার করার সুযোগ আছে। তাই এ আইন দ্রুত সংশোধন করা না হলে বর্তমান হালনাগাদ নিয়ে আইনগত প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা থাকছে।
এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কথা বলা থাকলেও তা কখনো সম্ভব হয়নি। তাই আগের কমিশন বছরের সুবিধামতো সময়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রস্তাব করেছিল। এসব কারণে আগের কমিশন চেয়েছিল আইনটি দ্রুত সংশোধন হোক।