পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে সেতু বিভাগের তিন প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্তুষ্ট হতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন ৩ প্রকৌশলী।
দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী লিয়াকত আলী, সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ ও সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম মর্তুজা গত বছর এসএনসি লাভালিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে দুই সপ্তাহের জন্য কানাডায় যান।
বুধবার সকাল ১১টায় দুদকের রাজধানীর সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলি ও মির্জা জাহিদুল আলম ৩ ঘণ্টা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
সূত্র জানায়, এ তিন কর্মকর্তাকে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি প্রশ্ন করে-‘‘পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগের আগে আপনারা কানাডায় এসএনসি লাভালিনের প্রশিক্ষনে অংশ নিয়েছেন কি-না?’’
প্রশ্নের জবাবে দুদকের অনুসন্ধান কমিটিকে এ ৩ প্রকৌশলী জানান, তারা এসএনসি লাভালিনের কোনো প্রশিক্ষনে অংশ নিতে কানাডায় যাননি।
দুদক এ কথার উত্তরে প্রশ্ন করে- ‘‘তাহলে গত বছর কানাডায় যাননি?’’ অনুসন্ধান কমিটির এ প্রশ্নের উত্তরে তিনজনই জানান, তারা কানাডায় গিয়েছেন। দুই সপ্তাহ তারা সেখানে ছিলেন বলেও দুদককে জানান।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, দুদক মনে করছে, এ তিন প্রকৌশলী পরিকল্পিতভাবে একই ধারায় উত্তর দিয়েছেন। জানা গেছে, এ তিন প্রকৌশলীর কানাডায় যাওয়ার ভিসা, আনুষঙ্গিক কাগজপত্র খতিয়ে দেখছে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি। কেন তারা ২ সপ্তাহ কানাডায় ছিলেন, এ দুই সপ্তাহে কোথায় কি করেছেন, তা অনুসন্ধান করছে দুদক।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জুন বহু কাঙ্ক্ষিত পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল।
এর আগে পদ্মাসেতুর অর্থ যোগানদাতা বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১১ অক্টোবর তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। এ নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিতর্কের মুখে পড়েন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ, সেতু নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়ায এবং পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম থাকতে পারে। দুর্নীতির সঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের সম্পৃক্ততার অভিযোগও এতে তুলে ধরা হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। সরকারের পক্ষ থেকেও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদকও জানায়, মূল সেতু নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মূল্যায়ন কমিটি পরামর্শক হিসেবে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল।
এর প্রথমটি ছিল এসএনসি লাভালিন। অন্যগুলো হলো- যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ ইউকে, নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একম অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি হাই পয়েন্ট রেলেন্ড।
এর মধ্যে এসএনসি লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপরই এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার সহায়তা স্থগিত করে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুললে এ নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করে।
পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত কমিটি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগের ভিত্তিতেই দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে আবার তদন্ত শুরু করেছে দুদক। এর অংশ হিসেবে গত মাসে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও জাতীয় সংসদের হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গত সোমবার এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে । দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনজনের কেউ ঘুষ গ্রহণ করতে রাজি, উদ্যোগী বা ঘুষ গ্রহণ করেছেন বলে স্বীকার করেননি।
দুদকের তদন্ত শেষ করার আগেই বিশ্বব্যাংক গত শনিবার ঋণচুক্তি বাতিল করে। দুদকের পক্ষ থেকে এ ঋণচুক্তি বাতিলকে অন্যায্য ও অবিবেচনাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তবে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করলেও পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলবে বলে জানান তিনি।