মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুনকে আসামিপক্ষের জেরা বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ২ সদস্যের ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় দিনের মতো মুনতাসীর মামুনকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
জেরায় আসামিপক্ষের প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, “জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক ও ধর্মব্যবসায়ী দল। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দলটি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে।“
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি কোনো নির্দেশনা দিলে তা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যেতো।“
মুনতাসীর মামুনকে তার লেখা ও সম্পাদিত বই সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেন মিজানুল ইসলাম। সেগুলোর জবাবে তিনি জানান, তিনি বই না দেখে কিছু বলতে পারবেন না। এক পর্যায়ে আসামিপক্ষ মুনতাসীর মামুনকে তার বইপত্র নিয়ে এসে জবাব দানের সুযোগ দিয়ে জেরা করার জন্য সময় আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করে দেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, “সাক্ষী তার লিখিত কোনো বই বা তথ্য ছাড়াই সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই জেরাও করতে হবে সেগুলোর সাহায্য ছাড়াই।“
ট্রাইব্যুনাল এ পর্যায়ে বুধবার আসামিপক্ষকে জেরা শেষ করার আদেশ দেন।
এর আগে রোববার সাক্ষ্য দানকালে মুনতাসীর মামুন ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম। ৪০ বছর পরও ধর্ষণ, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের কথা স্মরণ করে শিউরে উঠি। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ না করলে হয়তো ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কমে যেতো এবং আমরা আগেই জয়ী হতে পারতাম।’’
সাক্ষ্যে মুনতাসীর মামুন বলেন, “২৫ মার্চের কয়েকটি সংবাদপত্র যেমন ডেইলি অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান, সংগ্রাম, পূর্বদেশ পত্রিকাগুলোর ব্যাপারে আমি বলতে পারি। এসব তখন ছিল অবরুদ্ধ দেশের সংবাদপত্র। কোনো পত্রিকাই সরকারের অনুমোদনহীন খবর প্রকাশ করতে পারতো না। সে সময় এসব পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলা হতো। আমরা রাজাকার বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে এসব পত্রিকা পড়তাম। এছাড়া প্রকৃত খবরের জন্য রেডিও অস্ট্রেলিয়া, আকাশবাণীর ওপর নির্ভর করতে হতো। মার্চ মাসে যেসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করছিল, তার মধ্যে আছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, পিডিপি এবং আরও কিছু দলের শাখা। তবে জামায়াত ও মুসলিম লীগের ভূমিকাই ছিল বেশি।”
“২৫ মার্চের পর থেকে কোনো কোনো দল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে এবং তাদের প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল টিক্কা খানকে সহায়তা করছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেছিল, যখন প্রতিদিনই পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট, ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এদের প্রধান সহযোগী ছিলেন নুরুল আমীন ও গোলাম আযম। তাদের পরামর্শেই শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি পরে দুইভাগ হলেও খাজা খয়েরউদ্দিন ও গোলাম আযমের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তারা পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা পেয়েছিল। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গঠন করা হয়েছিল রাজাকার, আলবদর, ও আলশামস বাহিনী। এসব বাহিনীতে জামায়াতের লোকদেরই প্রাধান্য ছিল।”
মুনতাসীর মামুন বলেন, “সে সময় সংবাদপত্রগুলো দেখলে আমরা গোলাম আযমের বক্তব্য দেখতে পাবো। রাজাকার বাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল গোলাম আযমের মাধ্যমে। পরে পাকিস্তান সরকার এর একটি আইনি কাঠামো তৈরি করেছিল। আলবদরের নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী।”
মামুন তার কয়েকটি বইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমার বইগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির ওপরই বেশি আলোচনা করেছি। পাকিস্তানিদের যারা সহায়তা করেছিল, তাদের মনোযোগ কেমন সেটা নিয়েই ছিল আমার প্রধান কৌতূহল। তারা এমন ধ্বংসযজ্ঞ কীভাবে চালাতে পারলো?”
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের ওপর অধ্যাপক মুনতাসীন মামুনের লেখা কয়েকটি বই আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: রাজাকারের মন (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), পাকিস্তানের জেনারেলদের মন, সেই সব পাকিস্তানি, মুক্তিযুদ্ধকোষ (সম্পাদনা), মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র (সম্পাদনা), ১৩ নম্বর সেক্টর প্রভৃতি।
তিনি বলেন, “আমার সম্পাদনায় সোয়া দুইশ’র মতো বই আছে।”
“মূলত পাকিস্তানি সহযোগীদের লক্ষ্য ছিল, তৎকালীন ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, সম্পদ লুটের মাধ্যমে আহরণ করা, হত্যা ও ধর্ষণকে জনগণকে দমিত করার জন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।”
তিনি বলেন, “তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত শান্তি কমিটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়েছে, বাঙালি নারীদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সদস্য ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষদের হত্যা-ধর্ষণ করেছিল তারা। তারা পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের প্ররোচনা ও প্রণোদনা দিয়েছিল। আর এসবের নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আযম। এর প্রমাণ আমরা পত্র-পত্রিকায় পাই।”
মুনতাসীর মামুন আরো বলেন, “দেশজুড়ে অসংখ্য যে বধ্যভূমি পাওয়া গেছে, তাতে আমার ধারণা, ’৭১ সালে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। অনেককে হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অনেকের গণকবরে স্থান হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমি বরিশালের উজিরপুরে একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ধানচাষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। রাজাকাররা পাকস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ওই গ্রামের বহু মানুষকে হত্যা করেছিল।”
“মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে জামায়াত নেতারা সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। আমি বিশেষ করে নারী নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরতে চাই। আমার কাছে যেসব কাগজ আছে তাতে দেখা যায়, ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল রাজাকাররা। বলা হয়, ধর্ষিতার সংখ্যা চার লাখ। কিন্তু আসল সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। আমি এসব কথা মনে করতে চাই না। কারণ, শান্তি কমিটির বেশির ভাগই ছিল বাঙালি। সে সময় আমরা কতটা মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়েছিলাম?”
“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও গোলাম আযম ‘পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন’ করেন। আমার জীবনকালে আমি এত রক্ত, হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না।”
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ আল মালুমের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘একটি কথা সত্যি, ’৭১ সালে এসব ঘটনা ঘটেছিল।’’
সাক্ষ্যদানের পর অধ্যাপক-গবেষক মুনতাসীর মামুনকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। রোববারও জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম।
মুনতাসীর মামুনকে মিজানুল ইসলাম জিজ্ঞাসা করেন, “গোলাম আযমের সঙ্গে আপনার কি কখনো দেখা হয়েছিল?’ মামুন উত্তরে বলেন, ‘আমার সঙ্গে গোলাম আযমের কখনো দেখা হয়নি। তার সঙ্গে দেখা করা আমি নিরাপদও মনে করি না।”
আরেক প্রশ্নোত্তরে মুনতাসীর মামুন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম।”
এরপর সোমবার পর্যন্ত মুলতবি জেরা মুলতবি করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সোমবার তিনি ট্রাইব্যুনালে আসতে না পারায় মঙ্গলবার জেরার দিন ধার্য করা হয়।
এদিকে রোববারই গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষী তালিকা, ১০সিটি, ছয় হাজার পৃষ্ঠার ১২ খণ্ডের নথিপত্র জমা দেন তার আইনজীবীরা। গোলাম আযমের পক্ষের সাক্ষী সংখ্যা দুই হাজার ৯৩৯ জন।
গত ১৩ মে মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১ অভিযোগে অভিযুক্ত করে গোলাম আযমের বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
তার বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো— মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়া।
অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোলাম আযমের নেতৃত্বে নানা জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাইওনিয়ার ফোর্স, মুজাহিদ বাহিনী নামে পাকিস্তানপন্থী সংগঠন গঠন করা হয়। এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্বও ছিল তার।
এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি’ নামের একটি কমিটি গঠন করে তিনি দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের বিপক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি লন্ডন থেকে ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন, যাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালানো হতো।
১৯৭৫ সালে সৌদি আরব ভ্রমণ করে সেখানে গোলাম আযম অভিযোগ করেন, ’৭১ সালে বাংলাদেশের হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা করেছে, কোরআন পুড়িয়েছে, মসজিদ ভেঙেছে। এছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুস্কৃতিকারী ও অনুপ্রবেশকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৭১ থেকে ৭ বছর লন্ডনে বাস করার পর গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৮ সালে।
উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়।
পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারে পাঠানোর পর চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন।