কাদের মোল্লার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর হাতে একাত্তরের ২৫ নভেম্বর কেরানীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের বড় ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য বাঙালিকে গণহত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-২ তুলে ধরেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ খান। এ গণহত্যার শিকারদের অন্যতম ছিলেন দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা ও ওসমান গনি।
জামায়াতের বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার এই কাদের মোল্লা একাত্তরে তার নৃশংসতার জন্য ‘মিরপুরের জল্লাদ বা কসাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মঙ্গলবার মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দানকালে ওই গণহত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন মোজাফফর। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন কেরানীগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনিই মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছিলেন।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার মোজাফফর আহমেদ খানের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সকাল দশটা ৪১ মিনিট থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাক্ষ্য দানকালে মোজাফফর কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে গণহত্যা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী তাকে সাক্ষ্য প্রদানে সহায়তা করেন।
মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর সাক্ষ্যে বলেন, “আমি ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পরে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করি। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরে গুলির আওয়াজ পাই। পরে আমি আমার ট্রুপ নিয়ে কলাতিয়া নাজিরপুর থেকে ঘাটারচরের দিকে মুভ করি।”
তিনি বলেন, “ওই সময় পথে আমার বাবা নূর মোহাম্মদ খানের সঙ্গে দেখা হয়। বাবা আমাকে দেখে বলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি বললাম, ঘাটারচরের দিকে যাচ্ছি। বাবা আমাকে বললেন, সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা হামলা করেছে। আমাদের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর খানবাড়িতে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা হামলা করে তোমার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি ও গোলাম মোস্তফাকে হত্যা করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি ওদিকে যেও না।”
এর আগে মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি ও মোস্তফা কলাতিয়া ক্যাম্প থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। ওই সময় তারা হামলার শিকার হয়ে শহীদ হন বলেও জানান সাক্ষী মোজাফফর।
তিনি বলেন, “আমার বাবা আমাকে বলেন, তোমার হাতে যে অস্ত্র আছে, সে অস্ত্র থেকে ফায়ার করো না। আমি আমার বাবার কথা শুনে ওই স্থান থেকে নিরাপদ নিচু জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আমার ট্রুপসহ বসে পড়লাম।’’
‘‘বাবাকে বলি, আমি এদিকটা দেখছি। আপনি আমাদের ক্যাম্পে যান। এই বলে বাবাকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলাম।”
তিনি বলেন, “ওই ঘটনা সম্ভবত ফজরের নামাজের সময় থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ঘাটারচরে মোট ৫৭ জনকে হত্যা করে। এরপর বড় ভাওয়াল খান বাড়িতে হামলা চালিয়ে আরো ২৫ জনকে হত্যা করে। সকাল ১১টার পর খবর পাই পাকিস্তানি বাহিনী এলাকা ত্যাগ করেছে।’’
‘‘আমি প্রধান রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পেছন দিক থেকে প্রথমে ভাওয়াল খান বাড়িতে যাই। সেখানে দেখি, ওসমান আর মোস্তফার লাশ পড়ে আছে। পরে আমাদের বাড়িতে এসে দেখি, ঘর আগুনে পুড়ছে। ওসমান আর মোস্তফার দাফনের ব্যবস্থা করে ব্যবস্থা করে আবার পেছনের রাস্তা দিয়ে ঘাটারচরে চলে আসি। তখন সেখানে দেখি, বীভৎস অবস্থা। চারদিকে রক্ত আর রক্ত, লাশ আর লাশ।’’
‘‘ঘাটারচরে এসে তৈয়ব আলী ও আব্দুল মজিদের সঙ্গে দেখা হয়। তৈয়ব আলী ও আব্দুল মজিদ দু’জনে মিলে হিন্দু ও মুসলিমদের লাশ চিহ্নিত করেন।”
“পরে তৈয়ব আলী ও আব্দুল মজিদ দু’জনের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনলাম। তাদের কাছে জানতে চাই, এলাকার এ গণহত্যা কার নির্দেশে কিভাবে ঘটলো? আব্দুল মজিদ জানান, আনুমানিক ২৩/২৪ নভেম্বর ঘাটারচর এলাকায় একটি সভা হয়েছিল। মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতা ড. জয়নাল, কে জি করিম বাবলা, মোক্তার হোসেন, ফয়জুর রহমানসহ এরা ছাত্রসংঘের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেন। ওই মিটিংয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা উপস্থিত ছিলেন এবং তাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে ২৫ নভেম্বর।”
সাক্ষ্য দানকালে ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ সালের নির্বাচন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মক্তিযুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান মোজাফফর। তিনি বলেন, ‘‘একাত্তর সালে ছাত্র ছিলাম। সে বছরই কেরানীগঞ্জের আরসি বাউল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। ১৯৬৯ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেরানীগঞ্জ থানার সভাপতির দায়িত্ব পাই। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেই।’’
‘‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে এলাকার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেই। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আশরাফ আলী চৌধুরী। আমি তার পক্ষে ঢাকা মহানগরের মিরপুর-মোহাম্মদপুর এলাকায় কাজ করি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জামায়াতের গোলাম আযম দাঁড়িপাল্লা মার্কা নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। গোলাম আযমের পক্ষে আব্দুল কাদের মোল্লা নির্বাচনী প্রচারণা করেন।’’
ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও ক্ষমতা দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে মোজাফফর বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় আমরা বুঝতে পারি, দেশে কিছু একটা ঘটতে পাচ্ছে। পরে ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের ওপর হামলা চালিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করে।”
তিনি বলেন, “২৬ মার্চ রাতেই আমরা বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেবো। মে মাসে ১৫ জন সঙ্গীসহ ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। প্রথমে আগরতলা পৌঁছে সেখানকার কংগ্রেস ভবনে আমাদের নাম এন্ট্রি করি। পরে ওই স্থান থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের আসামের লায়লাপুরের সেনানিবাসে পাঠানো হয়। সেখানে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেই।”
মোজাফফর বলেন, “সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের জুলাইয়ের শেষের দিকে মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়। পরে মেজর হায়দার আলী ও ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আগস্টের শেষের দিকে আমি আমার ট্রুপ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। এলাকায় ফিরে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করি।”
মোজাফফর তার সাক্ষ্যে আরো বলেন, ‘‘ঘাটারচরের গণহত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে একদিন ছদ্মবেশে মামার বাড়ি ঢাকার মোহাম্মদপুরে মামার বাড়ি যাই। সেখান থেকে ফেরার সময় মোহাম্মদপুর শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনে কাদের মোল্লাকে কয়েকজন সঙ্গীসহ অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।’’
‘‘মোহাম্মদপুর শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দখল করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো, সেটা আমি জানতাম’’ উল্লেখ করে মোজাফফর আরো জানান, ‘‘কাদের মোল্লা সেখানে ধরে আনা মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর অনেক দিন ধরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। এ প্রসঙ্গে তিনি সাক্ষ্য দানকালে বলেন, ‘‘শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কর্নেল নূরুজ্জামানের সঙ্গে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কাজ করেছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চেয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি।’’
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘‘২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা হত্যার বিষয়ে সিআর মামলা দায়ের করি (মামলা নং: ১৭/২০০৭)। পরবর্তীতে সেটি জিআর মামলায় রুপান্তরিত হয় (মামলা নং: ৩৪(১২)/২০০৭)।’’
‘‘ওই মামলার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লার বিচার চাই’’ বলেও উল্লেখ করেন মোজাফফর। সবশেষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী সাক্ষীকে আসামি শনাক্ত করতে বললে আবদুল কাদের মোল্লাকে শনাক্ত করেন মোজাফফর আহমেদ খান।
সাক্ষ্য দান শেষে তাকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট একরামুল হক। ট্রাইব্যুনাল আগামী ৮ জুলাই প্রথম সাক্ষী মোজাফফর আহমেদ খানকে আসামিপক্ষের জেরার পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।