জড়িত পুলিশ-কাস্টমস-বেপজা সিইপিজেড থেকে বছরে ৫০ কোটি টাকার পণ্য পাচার

জড়িত পুলিশ-কাস্টমস-বেপজা সিইপিজেড থেকে বছরে ৫০ কোটি টাকার পণ্য পাচার

চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে অবৈধপথে পণ্য পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না কোনোমতেই। পুলিশ, কাস্টমস ও বেপজা’র কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সঙ্গে পাচারকারী সিন্ডিকেটের যোগসাজশ থাকায় কোনো প্রচেষ্ঠাই পাচার রোধে সফল হচ্ছেনা বলে অভিযোগে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে প্রতিমাসে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার পণ্য অবৈধ পথে বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এভাবে বছরে পাচার হচ্ছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য। পাচার হওয়া এসব পণ্যের খুব কমই ধরা পড়ে।

গত ২২ মে বন্দর থানাধীন ব্যারিস্টার সুলতান আহমেদ কলেজ এলাকা থেকে ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের ৫০ হাজার মিটার শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাপড় ও ৫ বস্তা সুতা আটকের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের কর্মকর্তারা এসব তথ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, পণ্যগুলো সিইপিজেডস্থ শতভাগ রপ্তানিমুখী জেএমএস গার্মেন্টস লিমিটেড থেকে পাচার হয়।

র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউল আহসান সরওয়ার বলেন,  “আমরা অভিযান চালানোর পর এখন প্রকাশ্যে পাচারের কাজ হয়ত হচ্ছে না। কিন্তু পাচার থেমে নেই। পাচারকারীরা বিভিন্ন কৌশলে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।”

গত ২২ মে পাচার হওযা পণ্যের সঙ্গে ৬ আসামিকে আটক করে র‌্যাব। পরবর্তীতে তাদের স্বীকারোক্তিতে র‌্যাব সদস্যরা পাচারকারী চক্রের আরও ৬ মূল হোতার নাম জানতে পারেন। নগরীর বন্দর থানায় দায়ের হওয়া এ সংক্রান্ত মামলার এজাহারে র‌্যাবের ডিএডি ময়নুল ইসলাম বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

গোয়েন্দা তথ্য মতে ইপিজেড থেকে অবৈধপথে পণ্য পাচারকারী চক্রের মূল হোতারা হলেন, হুমায়ুন, জিয়াউল হক সুমন, আনোয়ার হোসেন, সিইপিজেডের জেএমএস গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্যবস্থাপক এবং সিকিউরিটি ইনচার্জ। তবে তাদের কাউকেই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বন্দর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন কুমার দে বলেন, “যাদের নাম এসেছে তারা সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেছেন। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিনি। জামিন পাওয়া আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগ নেই।”

বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে র‌্যাব চট্টগ্রাম জোনের উপ-অধিনায়ক জিয়াউল আহসান সরওয়ার বলেন, “মামলা তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সঠিক তদন্ত না করলে পাচারকারীরা আড়ালে থেকে যাবে। আর পাচারও রোধ করা যাবেনা।”

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিইপিজেড থেকে পাচার হওয়া পণ্য নগরীর পাইকারী কাপড়ের আড়ৎ টেরীবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারী দোকানে যায়। সেখানকার অনেক ব্যবসায়ী সিইপিজেডের কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শুল্ক সুবিধায় আনা পণ্যের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখে। সিইপিজেডের একাধিক সূত্র জানায়, টেরীবাজার ও রিয়াজউদ্দিন বাজারের কিছু নির্দিষ্ট দোকান খুঁজলে শুল্ক সুবিধায় আনা প্রচুর কাপড় ও জুতা পাওয়া যাবে।

সিইপিজেডের পণ্য পাচার চক্রর সঙ্গে কিছু কারখানা মালিক এবং বেপজা ও কাস্টমসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের কলকাঠিতেই শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য ইপিজেড থেকে বাইরে বের হয়।

মূলতঃ কাস্টমস ও বেপজাকে ‘ম্যানেজ’ করেই ইপিজেডের পণ্য বাইরে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে ‘ম্যানেজ’ করা যায় না কেবল সেসব চালানই ধরা পড়ে। এই ম্যানেজ প্রক্রিয়ায়ও চলে লাখ লাখ টাকার লেনদেন। বেপজা কর্তৃপক্ষের নমনীয়তার সুযোগ নিয়েই সিইপিজেডের দেশি কিছু প্রতিষ্ঠান এ অবৈধ কাজে লিপ্ত। ফলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব থেকে।

সূত্র জানায়, জেএমএস গার্মেন্টস থেকে পণ্য পাচারের আগে গত ২২ মে সকালে একটি মাইক্রোবাস ও একটি কাভার্ডভ্যান তিনবার ইপিজেডে ঢুকে আবার বের হলেও ইপিজেড সিকিউরিটি গেট, কাস্টম্স সিকিউরিটি কিংবা সংশ্লিষ্ট জেএমএস গার্মেন্টের সিকিউরিটি গেটের কোথাও গাড়িগুলোর প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ ছিল না। অথচ বন্ডেড এলাকা হওয়ায় ইপিজেডে চলাচলরত প্রতিটি গাড়ির তথ্য লিপিবদ্ধ থাকার নিয়ম রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সিইপিজেডের মহা-ব্যবস্থাপক এসএম আব্দুর রশিদ জানান, সিইপিজেডের ভেতর গার্মেন্টস থেকে পণ্য পাচারের ঘটনা তদন্তে কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বেপজায় পাঠানোও হয়েছে। পরবর্তীতে বেপজা থেকে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে।

এদিকে, এসআই সুমন কুমার দে জানান, তদন্তের জন্য কাস্টমসের কাছে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট চাওয়া হলেও তারা সরবরাহ করছে না। এ অবস্থায় পুলিশ নিজেই এসব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করছে।

অভিযোগ আছে, সিইপিজেড এলাকায় পাচারকারী সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে হুমায়ুন। এর আগে ৯৯ সালেও সানোয়ারা কর্পোরেশনের দুধের ট্রাক ডাকাতির ঘটনায় হুমায়ন একবার গ্রেফতার হয়েছিল।

অপরদিকে, সর্বশেষ এ ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে হুমায়ুনের নাম আসার পরও তাকে গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ না করায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এর আগে গত ৭ মে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে কাভার্ড ভ্যানে পাচারের সময় ৬০ লাখ টাকার সাড়ে ৭ হাজার জোড়া জুতা আটক করা হয়। এই পাচারের সাথে ইপিজেডেরই জুতা কারখানা ইউএফএম (বিডি) জড়িত ছিল বলে বেপজা গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা গেছে। কাস্টমসের তদন্তেও ইউএফএম (বিডি) এর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।  এই কোম্পানিটি এর আগেও একাধিকবার জুতা পাচারের সময় ধরা পড়েছে বলে ইপিজেড সূত্রে জানা গেছে।

বাংলাদেশ