প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিজিবি এখন অন্যান্য বাহিনীর মতো ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে উন্নীত হয়েছে। দুটি হেলিকপ্টার উদ্বোধনের মাধ্যমে আমি আজ বিজিবিকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করছি। আজকে থেকে বিজিবি ত্রিমাত্রিক বাহিনী।
আজ রবিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিজিবি এয়ার উইংয়ে সংযোজিত দুইটি নতুন এমআই-৭১ই হেলিকপ্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বিজিবিতে হেলিকপ্টার সংযোজনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। বিজিবি এয়ার উইংয়ের এ যাত্রা বিজিবির সার্বিক কর্মকাণ্ডকে আরও গতিশীল করবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে বিজিবি দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি অর্পিত দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে জলে, স্থলে ও আকাশপথে বিচরণ করবে। এটি শুধু বিজিবির উন্নতি নয়, মুজিববর্ষে এটি দেশবাসীর জন্যও অত্যন্ত গৌরবের ও আনন্দের বলে আমি মনে করি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে বলেছিলেন, এ বাহিনী দেশের সীমান্ত রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশপাশি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেছিলেন, ‘ইমানের সাথে কাজ করো, সৎ পথে থেকো, দেশকে ভালোবেসো’।
তিনি বলেন, এটা শুধু বিজিবি না, আমি মনে করি বাংলাদেশের সকলের জন্যই এটা প্রযোজ্য। আমি মনে করি প্রত্যেকেই জাতির পিতার এই নির্দেশনা মেনে চলবে এবং বিজিবি সদস্যরাও এই নির্দেশনা মেনে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সততা ও ইমানের সাথে দায়িত্ব পালন করে এই বিজিবির সুনাম অক্ষুন্ন রাখবে এবং এই বাহিনীকে একটা শ্রেষ্ঠ বাহিনী হিসেবে আপনারা গড়ে তুলবেন।
ছবি : ফোকাস বাংলা
ছবি : ফোকাস বাংলা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পরের মাসেই পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে রক্তাক্ত বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এর মাঝে কিছু ঘটনা ঘটেছে যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এই ধরনের ঘটনা আর ঘটুক সেটা আমরা চাই না। অনেক প্রাণ ঝড়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং যারা এই ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত তারা নিজেদের যেমন ক্ষতি করেছে, বাহিনীর ক্ষতি করেছে, দেশের ক্ষতি করেছে। ভবিষ্যতে আমরা আশা করি এই জাতীয় ঘটনা যেন না ঘটে।’
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের স্থলসীমানা চুক্তি জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে করে যান। কিন্তু এটা আইনও তিনি পাস করে যান, ভারত তখনও পারেনি। কিন্তু ১৯৭৫ এর পরে জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারা কখনও আমাদের সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন অথবা আমাদের সীমান্ত যে আমাদের, এটার ব্যাপারে তারা কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। আমি প্রথমবার যখন আসি তখন থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বিজিবিতে আরও জনবল বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এ বাহিনীতে আরও ১৫ হাজার জনবল বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছে যা তিনটি ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, প্রথম ধাপে ৪ হাজার ২৮২ জন জনবলের সমন্বয়ে একটি রিজিয়ন সদর দপ্তর, একটি সেক্টর সদর দপ্তর এবং ৪টি ব্যাটালিয়ন, একটি কে-নাইন ইউনিট, একটি রিজিয়ন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, একটি স্টেশন সদর দপ্তর, একটি গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সৃজনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ২০২২ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। দ্বিতীয় ধাপে মোট ৫ হাজার ৭৮২ জন জনবলের সমন্বয়ে একটি সেক্টর, পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, একটি রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন, একটি কে-নাইন ইউনিট অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং পাঁচটি বর্ডার গার্ড হাসপাতালের জনবল বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব বিবেচনাধীন রয়েছে।
উন্নত প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি সুশৃঙ্খল ও দক্ষ বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণের জন্য আমরা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি।
সাতকানিয়ায় বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজের পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গায় আরেকটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করার পরিকল্পনার কথা জানান শেখ হাসিনা।
বিজিবির কার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকা নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সীমান্ত এলাকা নির্বাচন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৩২৮ কিলোমিটার সীমান্তে স্মার্ট ডিজিটাল সার্ভেইল্যান্স অ্যান্ড ট্যাকটিক্যাল রেসপন্স সিস্টেম স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরাসরি নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল মোবাইল রেডিও (ডিএমআর) নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিজিবি সদর দপ্তর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বিওপি এবং বিওপি পরিচালিত টহলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বিজিবির অপারেশনাল সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং যেকোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
চোরাচালান প্রতিরোধে টহল কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১২০টি অল টেরেইন ভেহিক্যাল (এটিভি) এবং সীমান্তের সার্বিক সুরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় বিজিবির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১২টি আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং ১০টি রায়ট কন্ট্রোল ভেহিক্যাল কেনা হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
মাদক কারবারিদের ধরতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বিজিবির বহরে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি হাইস্পিড বোট এবং ২টি পন্টুন সংযুক্ত করা হয়েছে। তা ছাড়াও বিজিবির জন্য অত্যাধুনিক দুটি ফাস্ট ক্রাফট, সমুদ্রগামী ৭টি অত্যাধুনিক হাইস্পিড বোট, দুটি মেরিনা এবং দুটি ট্রেইলার ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সুন্দরবন সংলগ্ন জলসীমায় কার্যকর টহল পরিচালনার পাশাপাশি মায়ানমার সীমান্তে এসব উন্নত নৌযান মোতায়েন করে নাফনদী ও সাগর উপকূলে ইয়াবা পাচার ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সীমান্তের সার্বিক সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য বিজিবির সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত অতি পুরাতন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রের পরিবর্তে আধুনিক, যুগোপযোগী ও কার্যকর ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল কেনা করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে ৫৩৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় নতুন ৬২টি বিওপি নির্মাণের মাধ্যমে ৪০১.৫ কিলোমিটার সীমান্ত ইতোমধ্যে নজরদারিতে আনা হয়েছে। অবশিষ্ট ১৩৭.৫ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় আরও বিওপি স্থাপন করা হবে বলে জানান সরকারপ্রধান।
পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তর প্রান্তে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম।