সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হক। তবে পরামর্শকের কাজ পেতে কোনরকম তদবির করেননি বলে দাবি করেছেন তিনি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কানাডাভিত্তিক এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াউল হক সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্ত কর্মকর্তাদের জেরায় এ তথ্য দেন। সোমবার রাতে বাংলানিউজকে একটি সূত্র এ তথ্য জানায়।
সূত্র জানায়, তদন্ত কর্মকর্তারা জিয়াউল হকের কাছে প্রথমে জিজ্ঞাসা করেন তিনি আবুল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কি না। উত্তরে জিয়া বলেন, আবুল হাসান চৌধুরী তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা তাকে প্রশ্ন করেন- কত টাকার বিনিময়ে তিনি তাকে মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন? উত্তরে তিনি বলেন- টাকা-পয়সার বিষয় ছিল না। আবুল হাসান চৌধুরী আমার আত্মীয় আর আবুল হোসেন ওঁর বন্ধু। সেই সূত্রে তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
পরামর্শকের কাজ পেতে বিনিময়ে কত টাকা দেওয়ার কথা ছিল?- এ প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, “টাকা লেনদেনের বিষয় ছিল না। তবে, নিয়ম অনুযায়ী যদি লাভালিন কাজ পায় তাহলে অন্য কোন কারণে যেন বাদ দেওয়া না হয় এ বিষয়টি মন্ত্রীকে জানিয়েছি। সেই অনুরোধটাই করা হয়েছিল মাত্র।”
সূত্র জানায় ওই বৈঠকে কী কথা হয়েছিল এবং কারা উপস্থিত ছিলেন তার একটি তালিকা জিয়াইল হকের কাছ থেকে তদন্ত কর্মকর্তারা নিয়েছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এ বৈঠকে মধ্যস্থতা করেছেন বলে জানিয়েছেন জিয়াউল হক।
দুদকের উপপরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলি ও মির্জা জাহিদুল আলম জিয়াউল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তদন্তের প্রয়োজনে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।
সোমবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে জিয়াউল হক দুদক কার্যালয়ে যান। দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে তাকে ঘণ্টাখানেক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
সূত্র জানায়, গত ২৪ জুন জিয়াউল হককে দুদক কার্যালয়ে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউল হক দেশের বাইরে থাকায় পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জুন বহুকাঙ্ক্ষিত পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এতে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার কথা ছিল।
এর আগে পদ্মাসেতুর অর্থ যোগানদাতা বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১১ অক্টোবর তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিতর্কের মুখে পড়েন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ, সেতু নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগে প্রাক-যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়ায় এবং পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম থাকতে পারে। দুর্নীতির সঙ্গে সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাঁকো ইন্টারন্যাশনালের সম্পৃক্ততার কথা অভিযোগে তুলে ধরা হয়। সৈয়দ আবুল হোসেন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। সরকারের পক্ষ থেকেও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি দুদকও জানায়, মূল সেতু নির্মাণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনো রকম দুর্নীতি হয়নি।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মূল্যায়ন কমিটি পরামর্শক হিসেবে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করেছিল।
এর প্রথমটি ছিল এসএনসি লাভালিন। অন্যগুলো হলো- যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ ইউকে, নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একম অ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি হাই পয়েন্ট রেলেন্ড।
এর মধ্যে এসএনসি লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপরই এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার সহায়তা স্থগিত করে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুললে এ নিয়ে দুদক তদন্ত শুরু করে।
দুদকের তদন্ত শেষ করার আগেই বিশ্বব্যাংক গত শনিবার ঋণচুক্তি বাতিল করে। দুদকের পক্ষ থেকে এ ঋণচুক্তি বাতিলকে অন্যায্য ও অবিবেচনাপ্রসূত বলেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তবে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করলেও পদ্মাসেতুর পরামর্শক নিয়োগ বিষযে দুদকের অনুসন্ধান চলবে বলে জানান তিনি।
পরামর্শক নিয়োগের তদন্ত কমিটি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগের ভিত্তিতেই দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে আবার তদন্ত শুরু করেছে দুদক। এর অংশ হিসেবে গত মাসে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও জাতীয় সংসদের হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের ভাই নিক্সন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।