সরকারের ব্যাংকঋণ পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট বাড়বে

সরকারের ব্যাংকঋণ পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট বাড়বে

চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আর তা কার্যকর হলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে (নগদ মুদ্রার সংকট)পড়বে।

ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের এই বিশাল ঋণ গ্রহণের প্রভাবে পুঁজিবাজারে নগদ মুদ্রার (তারল্য) সংকট বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাবে। বিনিয়োগকারীরা তখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে ব্যাংকের দিকেই ঝুঁকবেন। এর ফলে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট বাড়াবে এবং বিরাজমান সংকট আরো ঘনীভূত হবে।

বিগত বছরগুলোর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা কম থাকলে তা দেশের সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক হয়। এতে সব ব্যাংকেরই গ্রাহককে দেওয়ার মতো অর্থ মজুদ থাকে। তখন মজুদ অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে গ্রাহক খুঁজে বেড়ায় ব্যাংক। সব ব্যাংক একই চেষ্টায় থাকে বলে সুদের হারও কমতে থাকে।

পক্ষান্তরে ব্যাংকে সুদের হার কম থাকায় গ্রাহকেরা ব্যাংক ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত কম মুনাফা পেয়ে থাকেন। ফলে তারা ব্যাংকে সঞ্চয় না করে বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন। কারণ, পুঁজিবাজারে ঝুঁকির পাশাপাশি মুনাফার সম্ভাবনাও বেশি। এসব ক্ষুদ্র সঞ্চয় পুঁজিবাজারে প্রবেশ করাতে পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়তে থাকে। যার ফলে শেয়ারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। যা পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা হতে সহায়তা করে।

কয়ক বছর আগে ফিরে গেলে দেখা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। এরপরের অর্থবছরে (২০০৯-১০) সরকার ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। উপরন্তু ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে ২ হাজার ৯২ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সর্বোচ্চ সুদের হার ছিল ১৩ শতাংশ। তবে এর নিচেও অনেক ব্যাংক আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ করেছে।

ওই বছর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ’র (ডিএসই) সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ ২০০৯ সালের ২ জুলাই ডিএসই’র সাধারণ সূচক ছিল ৩০৬৯ পয়েন্ট। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ না করায় ওই বছরের ৩০ জুন ডিএসইর সাধারণ সূচক দ্বিগুণ হয়ে ৬১৫৩ পয়েন্টে উঠে আসে।

এর কারণ হিসেবে ব্যাংক বিশ্লেষকেরা বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু তার পরের বছর সরকারের ঋণ গ্রহণ করার পরিবর্তে পরিশোধ করায় ব্যাংকে প্রচুর অলস অর্থের জমা হয়। বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে সীমার বাইরে গিয়েও বিনিয়োগ করে। যার ফলে পুঁজিবাজারের তারল্য প্রবাহ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

তবে পরবর্তী অর্থবছরের শুরুতেই অর্থাৎ ২০১০ সালের শেষ দিকে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ শুরু করে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে আলাদা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে ওইসব প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের একক গ্রাহক ঋণসীমা নির্ধারিত করে দেয়। ওই অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে। যা হঠাৎ করে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। যার ফলে ২০১০ সালের শেষ দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ ধস নেমে আসে পুঁজিবাজারে।

এক মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারির মধ্যে ডিএসই’র সাধারণ সূচক ৮৯১৮ পয়েন্ট থেকে ৯৭০ পয়েন্ট কমে ৭৯৪৮ পয়েন্টে নেমে যায়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত কখনো কিছুটা উত্থান আবার কখনো পতনের মধ্য দিয়ে সূচক কমেছে ৩৩৭৬ পয়েন্ট।

২০১০-১১ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় ২০১১-১২ অর্থবছরেও সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণ অব্যাহত থাকে। বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে নেওয়া হয়েছে ২৯ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায়।

সরকারের ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধিতে ব্যাংক সুদের হারও বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক সুদের হার ১৬ শতাংশ হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে সঞ্চয় রাখতেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১১ সালে পুঁজিবাজারে ৫৮৭ কোটি ৬১ লাখ ৯৪ হাজার ২২৬টি নতুন শেয়ার যুক্ত হয়েছে। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সর্বশেষ কার্যদিবস পর্যন্ত ডিএসই’র সাধারণ সূচক কমেছে ৩৩৭৬ পয়েন্ট। আর এক বছরে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট শেয়ার, ইউনিট ও বন্ডের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৯ কোটি ৫১ লাখ ৯৪ হাজার ২২৬টি। এসব শেয়ার যুক্ত হওয়ার কারণে সূচক বাড়ার কথা থাকলেও উল্টো কমেছে।

আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরেও সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেবে। এরই মধ্যে দেশের প্রায় সব ব্যবসায়ী সংগঠন ব্যাংকঋণ কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

ব্যাংক ঋণ নির্ভরশীলতায় সুদের হার বৃদ্ধি পেলে সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চলে যেতে পারে কি-না জানতে চাইলে পুঁজিবাজার ধসের কারণ নির্ণয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও  কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, “পুঁজিবাজার এখন যেহেতু একটু অস্থিতিশীল, সে হিসেবে সুদের হার বেশি হওয়াতে বিনিয়োগকারীদের সঞ্চয় ব্যাংকে চলে গেলেও যেতে পারে। কারণ, ব্যাংকে বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত।“

আর সরকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তাতে ব্যাংকে সুদের হার আর না বাড়লেও কমবে বলে মনে হচ্ছে না। এরই মধ্যে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে বিদেশি সহায়তা ও বন্ড মার্কেটকে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ করার সক্ষমতা কমে যাবে কি-না জানতে চাইলে ডিএসই’র সভাপতি রকিবুর রহমান স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, ‘সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পুঁজিবাজার শক্তিশালী হয়। আর সবাই সঠিকভাবে অংশগ্রহণ না করলে দুর্বল হয়ে যায়।’

 

 

অর্থ বাণিজ্য