পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিলে বিশ্ব ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্খিত মন্তব্য করে তা পুনর্বিবেচনার জন্য সংস্থাটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
শুক্রবার ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেওয়ার পরও বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই বিষয়টি বিশ্ব ব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।
“আমাদের নির্বাহী পরিচালক এই বিষয় নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তাদের (সিদ্ধান্ত) পুনর্বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করব।”
অর্থমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, “আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি- এই অর্থবছরেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে।”
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা ওঠে।
এই বিষয়ে সোমবার সংসদে বক্তব্য দেওয়ার কথাও জানালেও আকস্মিকভাবেই রোববার সংবাদ সম্মেলন ডাকেন অর্থমন্ত্রী।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন স্থগিতের পর সংস্থাটির সঙ্গে সরকারের আদান-প্রদান করা বিভিন্ন চিঠি সাংবাদিকদের দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ইকবাল মাহমুদ ও অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান, সেতু বিভাগের সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামও ছিলেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে বিশ্ব ব্যাংক দাবি করলেও অর্থমন্ত্রী বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক অসম্মানজনক বিবৃতি দিয়েছে। তারা যে অভিযোগ করেছে তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
“নানা রকম অহেতুক এবং অযাচিত মন্তব্য যাতে না হয় সেজন্য আমরা দুর্নীতির বিষয়ে যে সব চিঠিপত্র লিখেছি সেগুলো সবই আপনাদের হাতে তুলে দিলাম,” বলেন তিনি।
মুহিত বলেন, “এই যে চিঠিগুলো আপনাদের দিলাম। এগুলো একটু ভালোভাবে পড়বেন। পড়লেই দেখবেন আমরা কতভাবে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। একটু দেশপ্রেম নিয়ে ভাববেন। নিজের দেশের সম্মান রক্ষা করবেন।”
বিশ্ব ব্যাংকের একটি চিঠিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে- এক সাংবাদিক এই কথা তুললে উম্মা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, “চুরি করা কাগজ নিয়ে রিপোর্ট করলে সেই রিপোর্টের উত্তর আমি দিতে রাজি নই।”
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, “কানাডার এক ব্যক্তির ডায়রিতে একজন কারো কাছ থেকে টাকা দাবি করেছেন- এমন তথ্য দুর্নীতির প্রমাণ হিসেবে দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। এমন অভিযোগ দিয়ে দুনীতির প্রমাণ পৃথিবীর কোনো আইনই আমলে নেয় না।”
ঋণচুক্তি বাতিলের পেছনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো ভূমিকা আছে কি না- এই প্রশ্ন করা হলে মুহিত বলেন, “আমি জানি না। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নয়।”
পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল হওয়ায় অন্যান্য প্রকল্পে সংস্থাটির অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের ৩৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সে সব প্রকল্পে কোনো সমস্যা হয়নি।
“আশা করছি, এই সব প্রকল্পের কাজ এবং ভবিষ্যতে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তার ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।”
আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন ডাকার কারণ ব্যাখ্যা করে মুহিত বলেন, “যেহেতু জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলছে, সেহেতু আগামীকাল জাতীয় সংসদে বিস্তৃত বক্তব্য রাখব। জাতীয় সংসদের অধিবেশন আজকে হলে আমি আজকেই বক্তব্য দিতাম।
“কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির ফলে সংবাদ মাধ্যমে নানা ধরনের আধা-তথ্য অথবা অভিমত ব্যক্ত করা হচ্ছে বলে আমার মনে হল যে, বিষয়টিকে খানিকটা প্রাঞ্জল করার দায়িত্ব আমার রয়েছে। সেজন্য আজকে আপনাদের আমন্ত্রণ করেছি।”
কথিত দুর্নীতির বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে বিশ্ব ব্যাংকের বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা (বিশ্ব ব্যাংক) তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি- এই কথাটিও সঠিক নয়।”
২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। এরপর জুন মাসে এসে অর্থায়ন বাতিল করে। এতে তাদের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতের পর থেকে বাতিল পর্যন্ত সময়টিকে ‘দুর্দিন’ অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “গত নয় মাস ধরে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের আলোচনা এবং চিঠিপত্র আদান-প্রদান হচ্ছে এবং বিশ্ব ব্যাংকের সন্দেহ নিরসনের জন্য আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি।”
এই প্রসঙ্গে প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে ধরেন মুহিত।
তিনি বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের আগ্রহের কথা আমি আমার বাজেট বিষয়ক সমাপনী বক্তব্যে বিশদভাবে তুলে ধরেছি। সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে যখন বিশ্বব্যাংক আমাদের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা নিয়ে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের জন্য জারিজুরি করতে থাকে। এই চীনা প্রতিষ্ঠানের জারিজুরি সমস্তই এই প্রতিষ্ঠানের বাঙালি সহকারীর জালিয়াতি বলে ধরা পড়ে।”
বিশ্ব ব্যাংক অভিযোগ তোলার পর সেতু প্রকল্পের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয় বলে জানান অর্থমন্ত্রী। “এই বিষয়ে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন গত বছরের আগস্ট মাস থেকেই তদন্ত শুরু করে। তারা নির্মাণ ঠিকাদার সম্বন্ধে তদন্ত প্রতিবেদনও বিশ্ব ব্যাংককে এই বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রেরণ করেন,” বলেন তিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে কোনো হস্তক্ষেপ হয়নি দাবি করে মুহিত বলেন, “আমরা জানতে পারি যে, বিশ্ব ব্যাংক এইসব বিষয়ে যে নালিশ করেছেন, সে সম্বন্ধে অতিরিক্ত কোনো সাক্ষী-সাবুদ দেয়নি এবং কমিশন তাদের নিজস্ব উপায়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।”
এরপরও বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার তথ্য জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সমঝোতার খাতিরে এবং পদ্মা সেতুতে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি বিতাড়নের লক্ষ্যে আমরা অনেক বিষয়ে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিই।
“তারপরও বিশ্ব ব্যাংক কেন এই ঋণচুক্তি বাতিল করে অসম্মানজনক একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করল, তা বাস্তবেই অনাকাক্সিক্ষত এবং রহস্যজনক।”