একাত্তরে গোলাম আযমের পরামর্শ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর আল শামসের মতো বাহিনী গঠিত না হলে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা অনেক কম হতো; বাংলাদেশ আরো আগেই বিজয়ী হতে পারত বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসাবে বক্তব্য জবানবন্দি দিতে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে এ কথা বলেন গবেষক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন।
রোববার সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এর কার্যক্রম শুরু হলে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, একাত্তরে যে রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে নানাভাবে সহায্য, সহযোগিতা ও পরমর্শ দিয়েছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমীর গোলাম আযম ছিলেন তাদের অন্যতম।
“তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ না করলে হয়ত ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা কম হতো। আমরা হয়তো আরো আগেই বিজয়ী হতে পারতাম।”
৬১ বছর বয়সী এই গবেষক জানান, একাত্তরের মার্চ মাসে যেসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করছিল, তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, পিডিপি এবং আরও কিছু দলের শাখা অন্যতম। তবে বড় দল হওয়ায় জামায়াত ও মুসলীম লীগের ভূমিকাই ছিল বেশি।
মুনতাসির মামুন বলেন, ২৫ মার্চের পর কয়েকটি দল পূর্ব পাকিস্তানে জেনারেল টিক্কা খানকে সহযোগিতা দিচ্ছিল। এপ্রিলের শুরুতে প্রায় পতিদিনই পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশে হত্যা, লুটপাট চালাচ্ছিল। আর নুরুল আমীন ও গোলাম আযম এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিচ্ছিলেন। তাদের পরামর্শেই সে সময় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর, ও আলশামস বাহিনী। এসব বাহিনীতে জামায়াতের সদস্যদেরই প্রাধান্য ছিল।
“শান্তি কমিটি পাক হানাদার বাহিনীকে পথ দেখিয়েছে, বাঙালি নারীদের তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সদস্য ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষদের তারা হত্যা-ধর্ষণ করেছে। আর গোলাম আযম এর নেতৃত্বে ছিলেন।”
সেই সময়ের সংবাদপত্রগুলোতেও গোলাম আযমের এই সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায় বলে আদালতকে জানান অধ্যাপক মুনতাসির।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু গবেষণামূলক বইয়ের লেখক মুনতাসির বলেন, “পাকিস্তানিদের যারা সহায়তা করেছিল তাদের মূল আগ্রহের বিষয় নিয়েই আমার কৌতুহল ছিল। পাকিস্তানের সহযোগীদের লক্ষ্য ছিল মূলত ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, সম্পদ লুট এবং জনগণকে দমিয়ে রাখার জন্য হত্যা ও ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা।”
এ মামলায় সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহবায়ক ডা. এম এ হাসান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালেরও এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি, পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করা এবং হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ার ৫ ধরনের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল গত ১৩ মে ‘জামায়াতের গুরু’ হিসাবে পরিচিতি গোলাম আযমের বিচার শুরুর আদেশ দেয়।
গোলাম আযমের আইনজীবীরা মামলাটি অন্য ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও গত ১৮ জুন তা খারিজ করে দেয় আদালত।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত। ওই দিনই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়; তারপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে নানা জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, পাইওনিয়ার ফোর্স, মুজাহিদ বাহিনী নামে পাকিস্তানপন্থী সংগঠন গঠন করা হয়। এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্বও তার ছিল বলে ঐতিহাসিক বিভিন্ন দলিলে প্রমাণ রয়েছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা শুরুর পর খাজা খায়রুদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের যে শান্তি কমিটি হয়, তার তদারকিতে গঠিত কমিটির ছয় জনের এক জন ছিলেন গোলাম আযম।
এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান তিনি।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম ১৯৭১ থেকে ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশে আসেন।