প্রয়াত ভাস্কর্যশিল্পী নিতুন কুণ্ডুর মেধা-শ্রমে-ঘামে প্রতিষ্ঠিত অটবি ফার্নিচার এখন প্রতারণার অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথিতযশা শিল্পী নিতুন কুণ্ডু যে অঙ্গীকার নিয়ে শিল্প ও ব্যবসার অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, অটবি নামের প্রতিষ্ঠানটিতে এখন তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত।
কঠোর পরিশ্রম, সততা ও শিল্পের সমন্বয়ে ব্যবসা করার কারণে অটবি ফার্নিচারকে তিনি দেশের বৃহৎ একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর থেকেই তার গড়া প্রতিষ্ঠানে সততার অভাব দেখা দিতে শুরু করে।
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে নিতুন কুণ্ডুর মৃত্যুর পরই অটবি ফার্নিচারে শুরু হয় তার সন্তান বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অনিমেষ কুণ্ডুর স্বেচ্ছাচারিতা।
বাবার তৈরি করে যাওয়া বিশাল সুনামকেই বড় পুঁজি করে অতিরিক্ত দাম ও তার ওপর ভুয়া ডিসকাউন্ট এবং নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার চলতে থাকে। ফলে দিনে দিনে বাড়তে থাকে ক্রেতাদের ক্ষোভ। অটবির শো-রুমগুলোতে প্রতিদিনই জমা হচ্ছে ক্রেতাদের অভিযোগের পাহাড়। এক পর্যায়ে ব্যক্তি ক্রেতার পাশাপাশি বড় বড় ক্রেতাদেরও হারাতে থাবে অটবি।
সূত্র জানায় কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অটবির কর্পোরেট চুক্তি ছিল। যাদের বেশির ভাগই আর চুক্তি নবায়ন করছে না।
বছর জুড়ে ডিসকাউন্ট প্রতারণা
অটবিতে সারা বছরই ভুয়া ছাড় থাকে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বছর জুড়েই প্রতিমাসে অটবি বিভিন্ন নামে ডিসকাউন্ট দেয়। বৈশাখী ডিসকাউন্ট, আনন্দ অফার, স্বাধীনতা অফার, বিজয় অফার নামসহ বিভিন্ন নামে থাকে অটবি ডিসকাউন্ট। বর্তমানে চলছে এ প্রতিষ্ঠানটির তথাকথিত ‘ক্লিয়ারেন্স সেল’ এর নামে ভুয়া অফার।
জানা গেছে, পণ্যের উপর শুধু স্টিকার লাগিয়ে ডিসকাউন্ট লাগানো হয়। মূলত ডিসকাউন্ট দেওয়া হয় না। দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু স্টিকারে দেখানো হয় ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে অটবির ডিজিএম (কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট) আতিকুর রহমান বলেন, ‘ডিসকাউন্ট আমাদের কর্তৃপক্ষ যা ভালো মনে করছে তা দিচ্ছে। এটা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।’ তিনি এ বিষয়ে আর কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অটবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেষ কুণ্ডুর সঙ্গের কয়েকবার কথা বলতে চেষ্টা করা হলে প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়: “তিনি মিটিংয়ে এবং এসব বিষয়ে তিনি বলতে বাধ্য নন“।
অটবির মার্কেটিং বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “প্রতি মাসেই অটবি কৌশলে ভুয়া ছাড় দেয়। প্রতিমাসেই যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এভাবে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ছাড় দেয় তাহলে ব্যবসার লাভতো দূরে থাক মূলধনও থাকবে না।“
তিনি জানান, অটবি ছাড়ের নামে মাসজুড়েই ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
অতিরিক্ত দাম
দেশের শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানাজার বাংলানিউজকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “২০০৪ সাল থেকে অটবির ফার্নিচার আমাদের প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে আসছে, বর্তমানে নিম্নমানের ফার্নিচার এবং দায়সারা ফিটিং ও অতিরিক্ত মূল্যের কারণে চলতি বছরের শুরুতে অটবির সঙ্গে আমরা আর নতুন করে চুক্তি করিনি।“
তিনি বলেন, ‘অফিসের জন্য যেসব চেয়ার-টেবিল আমরা অটবির চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে অন্য কোম্পানি থেকে এবং ভালো মানের কিনতে পারবো সেক্ষেত্রে অটবি থেকে নেওয়ারতো প্রশ্নই আসে না।’
দেশের আরেকটি ফার্নিচার কোম্পানির একজন পরিচালক বলেন, “একই উপাদান আমাদের ও অটবির। অথচ অটবিতে আমাদের দামের চাইতে তাদের ফার্নিচারের দ্বিগুণ দাম রাখছে।“
তিনি আরও বলেন, “একই উপদানে তৈরি খাটের জন্য আমাদের বিক্রয় মূল্য ২৪ হাজার অথচ অটবিতে তা ৪০ হাজারের বেশি।“
দাম বেশির এ যুক্তি অবশ্য অটবি দিচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মী বেশী। অটবিতে কর্মরত শত শত কর্মীর বেতন, অফিস ভাড়া, পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের খরচসহ আনুসাঙ্গিক ব্যয় ফার্নিচারের দাম বাড়িয়েই তুলতে হয়।
দায়সারা ফিটিং
মাত্র দু’মাস আগে অটবি পান্থপথ শাখা থেকে একটি খাট কিনেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ইস্রাফিল হোসেন। গত সপ্তাহে খাটের পাটাতন ভেঙ্গে যায়। এ জন্য অটবির কাস্টমার কেয়ারে তিনি ফোন করেন। কাস্টমার কেয়ার থেকে তাকে সুন্দরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় বিক্রিত পণ্য ফেরত নেওয়া হয় না এবং কিছু ভেঙ্গে গেলে অটবি কর্তৃপক্ষ তা ঠিক করে দেয় না। বুধবার বিকেলে ইস্রাফিল অটবির পান্থপথ শো রুমে গিয়ে বিক্রেতাদের কাছে এ প্রতিবেদকের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কেনার সময় বলেছেন ভালো জিনিসের দাম বেশি। দু’মাসও খাটে ঘুমাতে পারলাম না অথচ আপনারা বললেন ভালো জিনিস।“
অটবির পণ্য কেনার পর প্রতিদিনই ক্রেতাদের এমন ক্ষোভ বাড়ছে।
সূত্র জানায়, শিল্পের প্রয়োগ ও উচ্চমান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থেকে অটবির এই বিচ্যুতির পেছনের কারণ পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও অধিক মুনাফা লাভের মানসিকতা।