আশির দশকে প্রয়াত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের দুই তুমুল জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতার একজন ‘কইনচাইন দেহি‘ খ্যাত এ এফএম আব্দুল আলী লালু মারা গেছেন কয়েক বছর আগে, অন্যজন ‘আচ্ছা বলুন তো’ খ্যাত সিরাজুল হক মন্টু এখন মৃত্যুপথযাত্রী। একজন এখন শুধুই একটি স্মৃতিময় নাম, অপরজন স্মৃতিবহনকারী দীর্ঘশ্বাস।
আব্দুল আলী লালু আর সিরাজুল হক মন্টু দুজনই ময়মনসিংহের সন্তান। প্রয়াত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই তারা পান তুমুল জনপ্রিয়তা। এই দুই অভিনেতাই একসময় টিভি ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। আব্দুল আলী লালু জীবনের শেষ বয়সে প্রচন্ড অর্থাভাবে দুঃস্থ অবস্থায় চিকিৎসার অভাবে ২০০৮ সালে ময়মনসিংহের ব্্রাম্মপল্লীতে নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তারই মানিকজোড় সিরাজুল হক মন্টুও এখন সেই পথে হেঁটে চলেছেন।
বলিষ্ঠ কৌতুক ও চরিত্রাভিনেতা সিরাজুল হক মন্টু এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। নানা রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে। ভুগছেন প্রচন্ড অর্থাভাবে। অসামর্থ্যরে কারণে তার চিকিৎসা বার বার ব্যাহত। প্রচন্ড শারীরিক কষ্ট সহ্য করে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে করে চলেছেন অবিরাম যুদ্ধ। সিরাজুল হক মন্টু শারীরিক অসুস্থতার কারণে অভিনয় জগত থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান কয়েক বছর আগে। শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ বয়সের বার্ধক্যে প্রায় ন্যুব্জ সিরাজুল হক মন্টু তার ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়া শেষ মোড় এলাকার বাসায় বর্তমানে স্ত্রীকে নিয়ে বর্তমানে অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন।
বছর ছয়েক আগে টানা দু’ বার ষ্ট্রোকের পর তার শরীরের ডানপাশ অবশ হয়ে যায়। ফিজিওথেরাপি ও ওষুধ-পথ্যের ব্যবহারে বর্তমানে কিছুটা হাঁটাচলা করতে পারলেও অভিনয়সহ স্বাভাবিক কর্মময় জীবনযাপন তার ফেরা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তার বয়স বর্তমানে সত্তরের কোঠায়। হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, প্রেসার, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত শারীরিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় তার জীবনযাপন হয়ে পড়েছে সীমাবদ্ধ। প্রায়ই তাকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। সুস্থ থাকলে বাড়ির সামনের দোকানপাটে নীরবে বসে থাকা আর পত্রিকায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খবর পড়ে ও পরিচিতদের কাছে অভিনয় জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে সময় কাটে তার।
সিরাজুল হক মন্টু বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত এবং মঞ্চের নিয়মিত অভিনয় শিল্পী ছিলেন। ময়মনসিংহ শহরের আকুয়াতে ৩০’র দশকে তার জন্ম। ১৯৪৭ সালে স্থানীয় সিটি ক্লাব থেকে অমরাবতী মঞ্চে ‘টিপু সুলতান’ নাটকে টিপুর ছোট ছেলে মোয়াজুদ্দিনের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবন শুরু হয়। ময়মনসিংহের কৃতি নাট্য ব্যক্তিত্ব আওলাদ হোসেন তারার কাছে সিরাজুল হক মন্টুর নাটকে হাতেখড়ি। তার অভিনয়গুণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহের অন্যতম বৃহৎ নাট্ট্য সংগঠন ঐতিহ্যবাহী অমরাবতী নাট্য মন্দিরের সদস্য করা হয়। সংস্থাটির সদস্য হওয়ার পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি এর নিজস্ব মঞ্চে (বর্তমান ছায়াবাণী সিনেমা হল) তাদের প্রযোজিত অনেক নাটকে অভিনয় করেন। এরপর তিনি চলে যান ঢাকায়।
টেলিভিশনে শুরুতে ‘বি’ গ্রেড ভুক্ত হলেও দেশ স্বাধীন হবার পর সিরাজুল হক মন্টু বিটিভির ‘এ’ গ্রেড তালিকাভুক্ত হন। টেলিভিশনের পাশাপাশি তিনি শুরু থেকেই বাংলাদেশ বেতারের একজন নিয়মিত তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। আশির দশকে বিটিভির ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানটি তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। অসুস্থ হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’’তে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। সিরাজুল হক মন্টুর অভিনয় জীবন চলচ্চিত্রেও ব্যাপ্তি ছিল। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘সুজন সখী’, ‘দর্পচূর্ন’, ‘মাটির ঘর’ প্রভৃতি। বহু টিভিনাটকেও তিনি অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি হানিফ সংকেত ময়মনসিংহে ইত্যাদি ধারণ করার সময় সিরাজুল হক মন্টুর অসহায় অবস্থা তুলে ধরেন।
পারিবারিক জীবনে সিরাজুল হক মন্টু তার নাটকের এক সময়ের সহ-অভিনেত্রী শান্তা হককে বিয়ে করেন। তার দু’ মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হলেও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। তাদের পক্ষে নিজেদের খরচ মিটিয়ে বাবার চিকিৎসা খরচ বহন করা কঠিন। সিরাজুল হক মন্টু তার অভিনয় জীবনে যা আয় করেছেন তা দিয়ে সংসারের খরচ ও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার পেছনেই ব্যয় করেছেন।
এ অবস্থায় আর্থিক অসঙ্গতির কারণে সিরাজুল হক মন্টু মৃত্যুর সাথে করে চলেছেন অবিরাম যুদ্ধ। সময়ের তাগিদেই এই অভিনেতার জীবনের গোধূলি বেলাটা যাতে একটু সুখকর হয় সেই জন্য সমাজের হৃদয়বান ও দরদী দানশীলদের এগিয়ে আসার প্রয়োজন।
সিরাজুল হক মন্টরু পরিবারের সদস্যরা জানান, বেতার-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও এ দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি অসুস্থ হবার পর কেউ খোঁজ রাখেনি। অসুস্থ শিল্পী হিসেবে পরিবার থেকে কোনও সাহায্যের আশা করা না হলেও সরকার থেকে কোনও যোগাযোগ না থাকায় তারা অনেকটাই হতাশ। হাতেগুনা দু’একজন ছাড়া তার বর্তমান অবস্থায় আর কোনও অভিনয় শিল্পী খোঁজ নেয়নি।
অসুস্থ, অসমর্থ্য ও নিঃসঙ্গ অভিনেতা সিরাজুল হক মন্টু নিজের দুঃখবোধ জানিয়ে বলেন, ‘নানা দুঃখ-কষ্ট আর সংগ্রাম করেও শুধুমাত্র অভিনয়কে ভালোবেসে জীবনে আর কিছু শিখি নাই, করিও নাই। অভিনয় করে মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছি সেটিই আমার জীবনের বড় পাওয়া।’
বর্তমান অসুস্থ আর নিসঃঙ্গ সময়ে এক সময়ের পুরনো সহকর্মী-শিল্পীরা খোঁজ খবর নেন কি না জানতে চাইলে খানিকটা অভিমানী মন্টু বলেন, ‘তারা হয়তো মন্টুকে ভুলে গেছে। পেটের তাগিদ আর চারপাশের ব্যস্ততায় একজন মন্টুকে স্মরণ রাখার সুযোগ কোথায়।’
অস্ফুট কন্ঠে অস্পষ্ট ভাষায় সিরাজুল হক মন্টু বলেন, ‘লালু ভাই চলে গেছে। আসলে জীবন চলে যতোক্ষণ জীবনের মাঝে প্রাণ থাকে। প্রাণপাখি যদি উড়ে যায় তবে থেমে যায় সবকিছু। হয়তো একদিন থেমে যাবে আমার জীবনঘড়ি।’