আদমজী বন্ধের ১০ বছর পূর্তি: কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেতে চলেছে

আদমজী বন্ধের ১০ বছর পূর্তি: কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেতে চলেছে

এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিলস বন্ধের ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ শনিবার। অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০০২ সালের ৩০ জুন বন্ধ করা দেওয়া হয়েছিল মিলটি। সেই থেকেই বন্ধ ছিল এটি।

তবে আবারও কর্মচাঞ্চল্যে প্রাণ ফিরে পেতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী এই শ্রম জনপদ।

২০০২ সালের ৩০ জুন আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেওয়ার পর ২০০৬ সালের ৬ মার্চ আদমজী ইপিজেডের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করা হয়। সেখানে এখন গড়ে ওঠেছে আদমজী রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (এইপিজেড)।

ইপিজেড সূত্র মতে, ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ১৫ কিলোমিটার ও জিয়া আন্তজার্তিক বিমান বন্দর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় অবস্থিত আদমজী ইপিজেড।

এর পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী শীতলক্ষ্যা নদী। ২৯২ দশমিক ৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত আদমজী ইপিজেডের ৩০৭টি প্লটের মধ্যে ১৫১টিতে ৬০টি দেশি-বিদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

এর মধ্যে দেশি ১৪টি, বিদেশি ৩০টি এবং যৌথ ১৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। ৫৭টি প্লটে প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন রয়েছে। বর্তমানে ৩৪টি কারখানা চালু রয়েছে।

কিছুসংখ্যক প্লটের নির্মাণ কাজ শিগগিরই শুরু হবে। এ কারখানাগুলোয় গার্মেন্টস, জিপার, কার্টুন, হ্যাঙ্গার, লেভেল, টেগ, জুতা, সোয়েটার, টেক্সটাইল, ডায়িংসহ ১শ শতাংশ রফতানিযোগ্য পণ্য সামগ্রী তৈরি করা হয়ে থাকে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোয় বর্তমানে ২০ হাজার ২৮২ জন শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। এর মধ্যে বিদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন। গত অর্থবছরে আরও চার হাজার চারজন বাংলাদেশি নাগরিকের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে এখানে। তবে কর্মরত ২০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর পরও বর্তমানে আরও ১০ হাজার শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে ওঠা এ ইপিজেডে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো টারমিনেশন করার পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রমিক সংকট তৈরি হচ্ছে। যদিও শ্রমিক টারমিনেশন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠাগুলোকে গচ্ছা দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কারখানা মালিকরা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার পরও নির্মাণ কাজ করছেন না।

নিউটপ টেক্সটাইল মিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৫টি প্লট নিয়ে মাত্র ২টি প্লটে কারখানা চালু করেছে। স্ক্যানডেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১০টি প্লট নিয়ে মাত্র ২টিতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। কুং তং নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০টি প্লট নিয়ে ১২টিতে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছে। তাছাড়া অনেক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান প্লট বরাদ্দ নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। আবার কিছু চলছে ধীরগতিতে।

এ বিষয়ে বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলানিউজকে জানান, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরে তাদের ইপিজেডের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ থাকে না। এ কারণে শ্রমিক সঙ্কট প্রকট হয়ে থাকতে পারে।

আদমজী ইপিজেড থেকে বছরে প্রায় সাড়ে ৭শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। হংকং, কানাডা, জার্মান, ইউইএ, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারত, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ এইপিজেডে বিনিয়োগ করেছে।

২ নং মিলটি চালুর উদ্যোগ
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আদমজীর ২নং মিলটি চালুর ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু গত সাড়ে ৩ বছরেও এটা চালু করা সম্ভব হয়নি। অথচ ২নং মিলটি পুনঃচালুর ব্যাপারে সূত্র: বপাম/পাট-২/বিজেএমসি/মিল-১ (অংশ-২) ২০০৪/১৩ তারিখ: ২১/১/২০১০ ইং স্মারকে চাহিত তথ্যাদি বিজেএমসি/পরি/এজেএম/ মন্ত্রণালয়/১০ তারিখ: ১/০২/২০১০ পত্রের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ (৩) এ ২নং মিলের জায়গায় পাটকল পুনঃস্থাপনের সুযোগ আছে উল্লেখ করে ৩টি প্রস্তাবনা পেশ করেছিলেন, যার মধ্যে ৩নং প্রস্তাবটি ৩৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রূপে আদমজী ২নং ইউনিটটি চালু করা হলে প্রতি শিফটে ১ হাজার ৭১৬ জন করে দুই শিফটে ৩ হাজার ৪৩২ জনের কর্মসংস্থান হবে এবং প্রতিদিন ৫০.৭০ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য উৎপাদন হবে।

উক্ত প্রস্তাবটির নানাদিক মূল্যায়ন করে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বিধায় ২০১০ সালের ৩০ মে মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটির সম্মতি দেয়। কিন্তু ২০১২ এর মাঝামাঝি এসেও প্রস্তাবনাটি আশার মুখ দেখেনি।

আদমজীর যাত্রা শুরু যেভাবে
সূত্র মতে, পূর্ব পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম ধর্ণাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ যৌথভাবে ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৭ একর জমি নিয়ে আদমজী জুট মিলস নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর ১৭শ হেসিয়ান ও ১ হাজার সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন শুরু হয়। তখন প্রায় ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত আদমজী জুটমিলে প্রতিদিন গড়ে ২৮৮ টন পাটের চট উৎপাদন করা হয়। তখন মিলে ৩ হাজার ৩শ টি তাঁতকল বসানো হয়।

ওই সময় মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। এ সময় আদমজী জুটমিল হয় পৃথিবীর অন্যতম জুটমিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা। মিলটিতে ২৪ হাজার ৯১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক চাকরি করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন।

১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশবলে দেশের অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আদমজী জুট মিলকেও জাতীয়করণ করে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশনকে (বিজেএমসি)। সেই সময় ২০০০ সাল পর্যন্ত মিলটিতে লোকসান হয় সাড়ে ১২শ কোটি টাকা। বিগত অনেক সরকার মিলটিকে বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও শ্রমিক রোষানলের কথা মাথায় রেখে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে। পরবর্তী বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালের ৩০ জুন আদমজী জুট মিল চিরতরে বন্ধ করে দেয়।

আদমজীর ভেতরে ৬টি মিলের মধ্যে ১, ২ ও ৩নং মিলে উৎপাদন হতো হেসিয়ান ও সেকিং। এগুলো থেকে তৈরি চটের ব্যাগ ও বস্তার একটি অংশ অভ্যন্তরিন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হতো। ৪নং মিলে তৈরি উন্নতমানের ব্রডলুম, জিও নামে পাটজাত পণ্য পুরোটাই বিদেশে রফতানি হতো। ৫নং মিলে (এবিসি) তৈরি হতো লেমিনেটেড পলি ব্যাগ। ৬নং মিলটি ছিল ওয়ার্কশপ। আদমজীকে ঘিরে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ঢাকায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। আদমজীর তিনশত একর এলাকা জুড়ে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ফলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দয্য সমৃদ্ধ এক মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা এশিয়ার বৃহত্তম সেই আদমজী জুট মিল এখন শুধুই স্মৃতি।

আদমজী জুট মিলে উৎপাদিত চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য দেশের চাহিদা পূরণ করে রফতানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। শুরুতে প্রায় ১শ টন পাটজাত পণ্য উৎপাদন হলেও ধীরে ধীরে তা বেড়ে আড়াইশ’ টনে উন্নীত হয়। আদমজীকে ঘিরে শীতলক্ষ্যার দুইপাড়ে সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও সোনারগাঁয়ে গড়ে ওঠে বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাস। মিল ছাড়াও এসব এলাকায় কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়।

আদমজী থেকে ইপিজেড
ঢাকা ও চট্রগ্রামের আশপাশে ইপিজেডসমূহে শিল্পস্থাপনের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রচুর সাড়া পাওয়ার কারণেই সরকার ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় আদমজী জুট মিল এলাকাকে ইপিজেডে রূপান্তর এবং আদমজীর সব সম্পদ বেপজার কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ওই বছরের ১৮ই জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তা অনুমোদন করেন।

২০০৬ সালের ৩০শে জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিজেএমসির তখনকার চেয়ারম্যান এএফএম সোলায়মান চৌধুরী বেপজার সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাকির হোসেনের কাছে বন্ধকৃত আদমজী জুট মিলের স্থাবর-অস্থাবর সমুদয় সম্পদের দলিল চুক্তি সম্পাদন ও হস্তান্তর করেন।

পরবর্তী সময় বেপজার নিজস্ব অর্থায়নে ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় আদমজী জুট মিলকে ইপিজেডে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়।

বাংলাদেশ