কয়েকদিনের টানা বর্ষণের কারণে সৃষ্ট পাহাড় ধসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম বিভাগের তিন জেলায় মোট ১১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছ। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২৯, কক্সবাজারে ৪৪ ও বান্দরবানে ৩৮ জন মারা গেছেন।
চট্টগ্রামে ২৯ জনের মৃত্যু প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত পাহাড় ধসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় ২৯ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে পৃথকভাবে পাহাড় ধসে ২৩ জন এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজন, হাটহাজারীতে দেয়াল ধসে ২ জন এবং বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় ড্রেনে পড়ে এক শিশুসহ আরও ৬ জন নিহত হয়েছেন।
এ হিসেবে একদিনের প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আকবর শাহ মাজার এলাকায় পাহাড় ধসে নিহত বানু আক্তার (৩০) নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে আকবর শাহ এলাকায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ জনে।
সব মিলিয়ে মঙ্গলবারের প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামে পৃথকভাবে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ জনে।
বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে দমকল বাহিনীর কর্মীরা সর্বশেষ লাশটি উদ্ধার করেন। এরপর সকাল ৯টায় আকবর শাহ মাজার এলাকায় উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে ফিরে গেছেন দমকল বাহিনীর কর্মীরা।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘বানু আক্তারের লাশ উদ্ধারের পর সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সেখানে আর কেউ নিখোঁজ নেই। এরপর আমরা উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছি।’’
দমকল বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, পাহাড় ধসে আকবর শাহ মাজার এলাকা থেকে এ পর্যন্ত যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তারা হলেন, বানু আক্তার (৩০), শানু (২৫), দেড় বছর বয়সী উর্মি, হোসনা বানু (৩০), আশামনি (১), সজীব (৪) এবং সাবিনা বেগম (২২)।
এর আগে গত মঙ্গলবার প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত ২৩ জনের মধ্যে আকবর শাহ মাজার এলাকায় ৭ জন, বিশ্ব কলোনি এলাকায় ৫ জন, জালালাবাদ আঁধারমানিক পাহাড়ে ৬ জন, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে ২ জন এবং বাঁশখালী শীলকূপ এলাকায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত আছেন আরো তিনজন।
একই দিন প্রবল বর্ষণে নগরীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজন, হাটহাজারীতে দেয়াল ধসে ২ জন এবং বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় ড্রেনে পড়ে এক শিশুসহ আরও ৬ জন নিহত হয়েছেন। এ হিসেবে একদিনের প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ জনে।
কক্সবাজারে পাহাড় ধস ও বজ্রপাতে নিহত ৪৪
পাহাড় ধস, দেয়াল চাপা, পানিতে ডুবে ও বজ্রপাতে এ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ জনে। একই সঙ্গে নিখোঁজ রয়েছেন আরো ১২ জন।
বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুণর্বাসন শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলায় দুর্যোগে মোট ৪৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে পাহাড় ধসে কক্সবাজারে মোট ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রামু উপজেলায় মারা গেছেন ৪ জন, চকরিয়া উপজেলায় মারা গেছেন ৫ জন, পেকুয়ায় ২ জন, মহেশখালীতে ৩ জন ও উখিয়া উপজেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বজ্রপাতে মারা গেছেন ৫ জন। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় ৩ জন, পেকুয়া উপজেলায় ১ জন ও মহেশখালীতে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেয়ালচাপায় মারা গেছেন ৩ জন। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরে ২ জন ও মহেশখালীতে ১ জন। এছাড়া, পানিতে ডুবে মারা গেছেন ৬ জন। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরে ১ জন, রামুতে ৩ জন ও কুতুবদিয়ায় ২ জন মারা গেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার দিনে পাহাড় ধসে মহেশখালী উপজেলায় নিহত হন চারজন, কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলে একজন, চকরিয়া উপজেলায় একজন এবং পেকুয়া উপজেলায় মারা যান একজন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী বৃহস্পতিবার ৪৪ জনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ভারী বর্ষণের কারণে জেলায় পাহাড় ধস, বজ্রপাত ও বাড়ির দেয়াল চাপায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাওয়া তথ্য মতে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টায় উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের সোনাঘোনা পাড়ায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। রাত ৩টার দিকে রামুর কাউয়ারকোপ ইউনিয়নের মধ্যম পাহাড়পাড়ায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় পাহাড় ধসে চকরিয়া উপজেলায় মারা গেছেন ৫ জন ও পেকুয়ায় ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার দিনে মহেশখালীর কালারমারছড়ায় পাহাড় ধসে মারা যান ৩ জন।
ওই দুই এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে।
এছাড়া, বজ্রপাতের ঘটনায় কুতুবদিয়া উপজেলায় বড়ঘোপ ইউনিয়নের লাল ফকিরপাড়ার খুকি আখতার (১৫) নামের এক কিশোরী নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে চকরিয়া উপজেলায় দুইজন, পেকুয়া উপজেলায় ১ জন ও মহেশখালীতে ১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হলেও এদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার রাত ১২টায় বাড়ির দেয়াল চাপায় কক্সবাজার সদরে ঈদগাঁও ইউনিয়নের দরগারপাড়া এলাকার আনোয়ারা বেগম (৫০) নামের এক নারী নিহত হয়েছেন। আনোয়ারা ওই এলাকার মোহাম্মদ ইসলামের স্ত্রী।
অপরদিকে, মঙ্গলবার রাতে রামু উপজেলার গর্জনীয়ার গর্জই খালে পারাপারের সময় নৌকা ডুবে ১২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি।
এদিকে টানা ভারী বৃষ্টির কারণে কক্সবাজারের প্রায় দেড় শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক, চকরিয়া-মহেশখালী সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী জানিয়েছেন, সব উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দূর্যোগ কবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেনাবাহিনী যৌথভাবে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঈদগাঁও ব্রিজের সংস্কার শুরু করেছে।
বান্দরবানে ৩৮ জনের মৃত্যু
বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের ১১ জনসহ মোট ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে একই পরিবারের আরও তিনজনের লাশ উদ্ধার করেছে উদ্ধাকর্মীরা। পরে আরও ৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
বুধবার সকাল ও মঙ্গলবার রাতে পর্যন্ত লামার ফাইটং ইউনিয়নে ও নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়নে কয়েকটি পাহাড় ধসে এসব প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ফাইটংয়ে একই পরিবারের ১১ জনসহ ২৪ জন ও নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া লামার রূপসী পাড়া ইউনিয়নে তিনটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। দুপুর পৌনে ১টার পর উদ্ধার তৎপরতা শেষ হয়। ঘটনাস্থল দুর্গম হওয়ায় বুধবার সকালে দেরি করে পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা সেখানে পৌঁছায়।
ফাইটং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম ও বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পাহাড় ধসের ঘটনায় সারা দেশের সঙ্গে জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।