রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জামায়াত। আর বিএনপিতে জন্ম নিয়েছে হতাশা। সরকার বিরোধী কঠোর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারায় এ দুই দলের মধ্যে হত্যাশা ও বিপর্যস্ততা তৈরি হয়েছে। জামায়াতের বিপর্যস্ততা আরও বেড়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিণতির দিকে এগুতে থাকায়।
গত এপ্রিলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর বিএনপির নেতৃত্বে জন্ম দেওয়া ১৮ দল আন্দোলনের ডাক দেয়। ইলিয়াস আলীকে ফেরত পেতে পর পর কয়েকদিন হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি পালন করে তারা।
এ আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে ২৯ এপ্রিলের হরতালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকায় গাড়ি পোড়ানো ও সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ মামলায় ১৮ দলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে তেজঁগাও ও শাহবাগ থানায় পৃথক দু’টি মামলা হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা সপ্তাহ খানেক পালিয়ে থাকেন।
উচ্চ আদালতে স্থায়ী জামিন না পেয়ে গত ১৬ মে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পন করেন জোটের শীর্ষ ৩৬ নেতা। আদালত তাদের জামিন না দিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। এরপর থমকে যায় বিএনপি, ঠাণ্ডা হয়ে আসে আন্দালনের গতি। ক্ষুব্ধ হয় সাধারণ কর্মীরা। যদিও ১১ জুন একটি সফল জনসভা করে তারা, তবুও কর্মীরা মনে করছে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে ১৮ দল। আর এ কারণে হতাশা নেমে আসছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
১৮ দলীয় জোটের অধিকাংশ নেতা মুক্তি পেলেও দলটির আন্দোলন কর্মসূচিতে মাঠে থাকা যুব নেতারা মুক্তি পাচ্ছেন না। যুব নেতা নীরব, সোহেল, সপু, মিজান ও জাহাঙ্গিরসহ ডজন খানেক নেতার মুক্তির পরই জেল গেটে আবার তাদের আটকে দেওয়া হয় অন্য মামলায়। নেওয়া হয় রিমান্ডে।
বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল অসুস্থ। বিএনপি তথা ১৮ দলের আন্দোলনের শক্তি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক সাদেক হোসেন খোকা দীর্ঘ সময় ধরেও অসুস্থ।
এছাড়া ১১ জুনের জনসভা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করতে, ইলিয়াস আলীকে ফেরত পেতে নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য সার দেওয়া ও ধান পাটের ন্যায্য মূল্য পেতে সরকারকে চাপ দিতে হরতাল অবরোধের মত কর্মসূচি দেওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া সেখান থেকে ফিরে আসেন। এর ফলে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে।
বিএনপির রাজনীতি করার কারণে কারও সন্তান কারও বাবা কারও ভাই হারিয়ে নিভৃতে কাঁদছে। পাচ্ছে না বিচারও। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগচ্ছে অনেক পারিবারের সদস্য। কাদঁছে তাদের পিতা, ভাই, স্বামী হারা ওইসব পরিবারের সদস্যরা।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মোট ২৪টি মামলা রয়েছে।
এসবের মধ্যে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫টি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি, কোকোর বিরুদ্ধে ৪টি ও তারেকের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে ১টি মামলা রয়েছে।
এর মধ্যে অর্থপাচারের এক মামলায় কোকোকে ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।
এসব মামলা পশাপাশি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলায় যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন দলটির প্রধান খালেদা জিয়াও।
এদিকে জামায়াত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নানাভাবেই রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করে আসছে। এর আগে কোন সরকারের সময় তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এতো মামলাও হয়নি। গ্রেপ্তারও হয়নি এত নেতা-কর্মী। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে মামলা হামলা গ্রেপ্তারে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ক্যাডার ভিত্তিক এ রাজনৈতিক দলটি।
স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির সঙ্গে বেঈমানি করার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় দলটির ডজন খানেক সিনিয়র নেতাসহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। অনেকে মুক্তি পেলেও এরমধ্যে যুদ্ধাপরাধ মামলায় কারাগারে আটক আছেন জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, আমীর মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহজারী সেক্রেটারী জেনারেল কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এটিএম আজহারুল ইসলাম।
গত ১৩ জুন আটক করা হয় জামায়াতের অন্যতম শক্তিধর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতা মীর কাশেম আলীকে। জামায়াতের নেতা-কর্মীরা মনে করেছিল তাদের সব নেতা গ্রেপ্তার হলেও মীর কাশেম আলী গ্রেপ্তার হবেন না। কিন্ত সেই বিশ্বাস পেছনে ফেলে তাকেও গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এ কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। অস্থির হয়ে উঠেছে তাদের ব্যাবসা সেক্টর। কমে এসেছে আন্দোলনের গতি।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশররফ হোসেন বলেন, রাজনীতি করলে জেলের ভয় করলে চলবে না। জেলে যেতে হবে সে চিন্তা করেই রাজনীতি করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় দল। এর থেকে দু’চার জন জেলে গেলে দলের মধ্যে হতাশা আসার কিছু নেই। তবে যারা জেলে আছে তাদের পরিবার ও যে দল করে তার (বিএনপির) দায়িত্বশীল নেতারা কিছুটা হলেও মানসিক চাপে থাকে।
জামায়াতের ঢাকা মহানগর কর্মপরিষদ সদস্য ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘জামায়াতের উপর অনেক নির্যাতন নিপীড়ন চলছে। নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে দলটির নেতা কর্মীদের। এ কারণে দলটির নেতা-কর্মীদের উপর ধকল যাচ্ছে। তবে এ নয় যে জামায়াত সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।’