ফিনিক্স পাখির মত তরুণরা চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আনবে : ফারুকী

ফিনিক্স পাখির মত তরুণরা চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আনবে : ফারুকী

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ছোটখাট মানুষ। তবে চিন্তা-ভাবনা তার বড় বড়। কথা বলেন খুব দ্রুত। মনের ভাব গুছিয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারেন। নিজের চিন্তাকে অন্যের মধ্যে সংক্রামিত করার ক্ষমতাও অসাধারণ। বাংলাদেশের টিভিনাটক যখন মেলো-ড্রামাটিক ধারায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ফারুকী নিয়ে আসেন রিয়েলিজম। আজকের নির্মাতাদের একটি বড় অংশ এখন সেই ধারার অনুসারী।

চলচ্চিত্র নির্মাণে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর হাতেখড়ি হয় ‘ব্যাচেলর’-এর মাধ্যমে। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণ প্রজন্ম  প্রতিনিধিত্ব করে তার এ ছবির কাহিনী বিন্যাসে। দ্বিতীয় ছবি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছবিতে নিয়ে আসেন ম্যাজিক-রিয়েলিজম।  ফারুকীর তৃতীয় ছবি ‘থার্ডপার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’ এর প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল মনস্তাত্বিক সংঘাত।

ফারুকী সম্প্রতি শেষ করেছেন তার চতুর্থ ছবি ‘টেলিভিশন’-এর শুটিং। বাংলাদেশ-জার্মান যৌথ প্রযোজনার এ ছবিটি এখন আছে এডিটিংয়ের টেবিলে। আগামী মাসে এ ছবির গান নিয়ে বের হচ্ছে অডিও অ্যালবাম। এ বছরের শেষ নাগাদ ছবিটি  আলোর মুখ দেখবে।faruki

‘টেলিভিশন’ ছবির এডিটিং প্যানেলের সামনে থেকে উঠে এসে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বারিধারা বসুন্ধরার পূর্ব-সীমানার নির্জন সবুজ প্রান্তরে আমাদের  মুখোমুখি বসলেন। স্বাভাবিকভাবেই কথোপকথনে ‘টেলিভিশন’ প্রসঙ্গ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি, পাশাপাশি উঠে এসেছে আরও কিছু বিষয়। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।

** শুরুতেই আপনার নতুন ছবি ‘টেলিভিশন’ সম্পর্কে জানতে চাই।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : দর্শকরা যেমন দেখতে চায় ‘টেলিভিশন’ ছবিটি হচ্ছে ঠিক তেমনই গরম ও নরম ছবি। গরম মানে যে জিনিস তাকে তীব্রভাবে হিট করবে, উত্তেজিত করবে বা চিন্তা করতে বাধ্য করবে। নরম মানে হলো মনের কোমল অনুভূতি। ছবিটি দর্শকের মনের কোমল অনুভূতিতে কাঁপন তুলবে। এ কারণে ‘টেলিভিশন’ ছবিটি হলো গরম ও নরম ছবি।

**‘টেলিভিশন’ ছবির গল্প সম্পর্কে বলুন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ‘টেলিভিশন’ ছবিটি হলো একটি গ্রামের গল্প। গল্পটিতে তুলে ধরা হয়েছে বাবা-পুত্রের সম্পর্ক, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক, ওস্তাদ-সাগরেদের সম্পর্ক। নতুন সময়ে পৌঁছে এই সম্পর্কগুলো বিবর্তিত হচ্ছে। আধুনিকতা আর প্রযুক্তি সম্পর্কগুলোকে পাল্টে দিচ্ছে। মোবাইল আসছে, ইন্টারনেট আসছে, টেলিভিশন আসছে। এসব প্রযুক্তি সম্পর্কগুলোর ধরণ পাল্টে দিচ্ছে। তৈরি করছে এক সম্পর্কের সঙ্গে অন্য সম্পর্কের কানামাছি খেলা। পিতার সঙ্গে পুত্রের কানামাছি খেলা, প্রেমিকের সাথে প্রেমিকার কানামাছি খেলা, বসের সঙ্গে কর্মচারীর কানামাছি খেলা, সেইসাথে নিজের সঙ্গে নিজের কানামাছি খেলা। নিজের বিশ্বাস আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কানামাছি খেলা খেলতে হয়। এই কানামাছির খেলার গল্পগুলোই তুলে ধরা হয়েছে ‘টেলিভিশন’ ছবিতে।

**ছবির নাম ‘টেলিভিশন’ কেন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : দুটি কারণে ছবিটির নাম ‘টেলিভিশন’। ছবিতে টেলিভিশন একটা চরিত্র। অন্যদিকে টেলিভিশন আধুনিকতার প্রতীক। আসলে এ কারণে যে ছবিটির নাম ‘টেলিভিশন’, তা নয়। একটা টেলিভিশন আমরা দেখি চোখ খুলে, আরেকটি দেখি চোখ বন্ধ করে। আমাদের প্রত্যেকের মনের ভিতরে একটি করে টেলিভিশন আছে। সেই টেলিভিশনের আমরা নিজেদের মতো করে ছবি দেখি। নিজের কল্পনা নিজের ফ্যান্টাসি সবই মানুষ তার ভিতরের টেলিভিশনে দেখতে পারে। ইচ্ছে করলে এই টেলিভিশনে নিজেই ঐশ্বরিয়ার হাত ধরে নাচতে পারে, যদিও বাস্তবে তা পারে না। বাস্তব আর কল্পনার জগতের মধ্যে কোনটা মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে। সবখানেই কি বাইরের টেলিভিশন অর্থাৎ বাস্তব জীবনের কাছে, কল্পনার টেলিভিশন হেরে যায়। নাকি কখনো কখনো কল্পনা হারিয়ে দেয় বাস্তবতাকে। এই প্রশ্নের উত্তর ছবিতে খোঁজা হয়েছে। তাই ছবিটির নাম ‘টেলিভিশন’।

** ছবির নামকরণের ক্ষেত্রে আপনি সবসময় ইংরেজি শব্দ বেছে নেন, এর কারণ কী?faruki

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আসলে বেছে নেই বললে ঠিক হবে না। এগুলো চলে আসে। কারণ যে পরিবেশে আমরা বাস করি সেখানে এই শব্দগুলো খুব পরিচিতি। ব্যাচেলর, টেলিভিশন বা ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার নম্বর শব্দগুলো আমাদের আশেপাশে ঘুরে। তাছাড়া ছবির নাম টেলিভিশন না রেখে আমি বাংলায় কী নাম দেবো? এটাকে কী দূরদর্শণ বলবো, সেটা কী শ্রুতিমধুর হবে বা দর্শক বুঝতে পারবে। কাজেই যেটি পরিচিত সেই ‘টেলিভিশন’ নামটি বেছে নিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, কারও চেয়ে বাংলার প্রতি প্রেম আমার কম আছে। তাই বলে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি বলা পাপ হবে, তাও আমি মনে করি না। কিন্তু হিন্দির প্রতি যাদের টান তাদের কাছে আহ্বান, এটা একটু কমান।

** বাংলাদেশ ও জার্মানি যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘টেলিভিশন’, এটাকে কী আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন ছবি বলা যায়?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি আমরা এখনো পৌছাতে পারি নি। এটা একদিনে হবে না। একদিনে বিপ্লব হয় না। আমাদের ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে এবং আমরা তা যাচ্ছিও। তাছাড়া দেশের বাইরে সিনেমা হল ভাড়া নিয়ে আমন্ত্রিতদের জন্য কয়েকটি শোর ব্যবস্থা করাকে সিনেমার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড মুক্তি দেওয়া বলা চলে না। তবে আনন্দের বিষয় হলো, ‘টেলিভিশন’ ছবিটি শুটিংয়ে যাওয়ার আগেই দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। ছবিটির চিত্রনাট্য এশিয়ান সিনেমা ফান্ড ও গোটেবার্গ ফিল্ম ফান্ডের পুরস্কার পায়।

**আমাদের ছবির মধ্যে বিভাজন আছে, মেইনস্ট্রিম ও অফট্র্যাক। নিজেকে আপনি কোন ধারার নির্মাতা বলে মনে করেন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, এটি জানি। মেইনস্ট্রিম আর অফট্র্যাক কিনা যাচাই করে দেখিনি। অনেকেই হিন্দি ছবির ফর্মূলা মার্কা ছবিগুলোকে মেইনস্ট্রিম ফিল্ম মনে করেন। আমি তো মনে করি, হিন্দি ছবির আদলে  তৈরি ওসব ছবিকে কোনোভাবেই মূলধারার ছবি বলা যায় না। বরং আমাদের সময় এসেছে নিজেদের একটি স্টাইল তৈরি করার। কপি করে নয়, নিজেদের স্বতন্ত্র স্টাইলে চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিতে হবে। আজকের তরুণ প্রজন্মের যেসব নির্মাতা নিজস্ব স্টাইলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন সেগুলোই আমাদের মূলধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। ফিনিক্স পাখির মত তরুণরা চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

** আপনার ছবিতে গানকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘টেলিভিশন’ ছবির গানের কথা বলুন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আমার ছবিতে যেভাবে ব্যাকগ্রাউন্ডে গান ব্যবহার করি, তা অনেকের পছন্দ নয়। ছবির গানে  লিপসিংয়ের সঙ্গে নাচানাচির ব্যাপারটা আমার পুরোপুরি আরোপিত বলে মনে হয়। এবারও আমার ছবিতে গান থাকছে ব্যাকগ্রাউন্ডে। ছবির গানগুলো বেশ যতœ নিয়ে করা হচ্ছে। আশা করছি আগামী ঈদে ‘টেলিভিশন’ ছবির গানের অ্যালবামটি রিলিজ পাবে। গানগুলোতে মেলোডি আর সুফি ঘরানার মিশেল থাকছে। গান লেখা, সুর করা এবং শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নতুন আর পুরাতনের জুতসই সম্মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি। সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন আইয়ুব বাচ্চু, হৃদয় খান ও চিরকুট ব্যান্ড। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন ন্যান্সি, হৃদয় খান, মিলন মাহমুদ, চিরকুট এবং লুৎফর হাসান। নতুন মেলোডি, নতুন আওয়াজ আর নতুন গায়কী পাওয়া যাবে এই গানগুলোতে। আশা করছি, বছর শেষে গানগুলো শ্রোতাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকবে।

** এবার বলুন আপনার ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কেমন অভিনয় করেছেন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: এ ছবিতে প্রধান তিনটি চরিত্রে অভিনয় করছেন মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী ও তিশা। মোশাররফ করিম বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে, এ ছবিতে তিনি এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যার বুক ফাঁটে তো মুখ ফোঁটে না, কথাটা ভুল। কারণ একপর্যায়ে তার ঠিকই মুখ ফোঁটে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী ও তিশা। আমার বিশ্বাস এই ত্রয়ীর অভিনয় দর্শকদের সিনেমার মধ্যে আটকে রাখবে।

** আপনার ব্যানার ছবিয়ালের বেশ কজন বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন। তাদের  মূল্যায়ন করুন?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : ছবিয়ালের ভাই-বেরাদরদের মাঝে মোস্তফা কামাল রাজের ‘প্রজাপতি’ ছবি মুক্তি পেয়েছে। তার নতুন ছবি ‘ছায়া-ছবি’ আসছে। রেদওয়ান রনি বানিয়েছে ‘চোরাবালি’ নামের একটি ছবি আর ইফতেখার ফাহমী বানাচ্ছে ‘টু বি কন্টিনিউড’ নামের ছবি। তারা প্রত্যেকে ছোটপর্দায় দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে চলচ্চিত্রে এসেছেন। তাদের কাছ থেকে আমরা মানসম্পন্ন ছবি পাবো। তাদের ঘিরে এই আমার বিশ্বাস।

** চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার আগামীর পরিকল্পনা কি ?

মোস্তফার সরয়ার ফারুকী: বাংলাদেশের ছবিকে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে কান আর ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখতে চাই। এখন এটা আমার ছবিই হোক আর অন্য কারোটাই হোক না কেন এবং এটা সম্ভব। আমাদের দেশের সরকারের পলিসি, তরুণ পরিচালক ও তরুণ দর্শকরাই বিপ্লব ঘটাবে। চলচ্চিত্রকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাবই। আর আমার কথা বলতে পারি, ছবি বানাচ্ছি এবং আগামীতেও ছবি বানাবো। কেননা আমি সেই পথ তৈরিতে ভূমিকা পালন করতে চাই।

** অবশেষে জানতে চাই, সংসার জীবন কেমন যাচ্ছে?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : আর সংসার জীবন। কাজের ব্যস্ততায় সংসার করার সুযোগ কোথায়। আমি আর তিশা, দুজনই ব্যস্ত। প্রতিদিন রাত ১২টায় দুজনের দেখা হয়। আবার ভোর ৬টায় বেরিয়ে যাই। এ ব্যস্তটায় সংসার যে করছি তাই তো বুঝিনা।

বিনোদন