জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র তৈরি করেছে দুদক। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে অভিযোগপত্রটি অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
মঙ্গলবার মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারি পরিচালক হারুনুর রশীদ অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেছেন, ইতিমধ্যেই অভিযোগপত্রটি কমিশনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিশনের অনুমোদন পেলেই তা আদালতে দাখিল করা হবে।
প্রস্তাবিত অভিযোগপত্র অনুযায়ী অপর তিন অভিযুক্ত হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তৎকালীন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ও বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ট্রাফিক বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকার সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খান।
প্রস্তাবিত অভিযোগপত্রে বলা হয়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের হিসাব নম্বরে সাত কোটি ৮০ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা লেনদেনের মধ্যে এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকার উৎসহীন অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
খালেদা জিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার প্রয়াত স্বামীর নামে ‘শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ গঠন করেন। যা ২০০৪ সালের ২৬ অক্টোবর গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল নম্বর ৩৩ মূলে রেজিস্ট্রি করা হয়।
ওই ট্রাস্টের ঠিকানা হিসেবে খালেদা জিয়ার তৎকালীন বাসভবন ৬ নম্বর মইনুল রোডের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।
প্রথম ট্রাস্টি খালেদা জিয়া নিজে এবং তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে ট্রাস্টের সদস্য করে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
খালেদা জিয়া প্রথম ম্যানেজিং ট্রাস্টি হিসেবে ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংক প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় শাখায় একটি সঞ্চয় হিসাব (হিসাব নং-৩৪০৭৬১৬৫) খোলেন। হিসাব খোলার পর থেকে ওই অ্যাকাউন্টে উৎসহীন অর্থ সংগ্রহ ও জমা করা হয়।
এর মধ্যে শাহজালাল ব্যাংক ধানমন্ডি শাখা থেকে ৫টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ওই অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পাঁচটি পে-অর্ডার মেট্রো মেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের নাম ব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অনুকূলে ইস্যু করা হয়।
মামলার তদন্তকালে মেট্রো মেকার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফএম জাহাঙ্গীর দুদককে জানান, তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে কোনো টাকা দান বা পেমেন্ট কোনোদিনই করেননি। এক্ষেত্রে তার কোম্পানির তহবিল থেকে কোন অর্থ ব্যয় হয়নি।
তবে মনিরুল ইসলাম খান দুদককে জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী নিজের টাকায় পে-অর্ডারের মাধ্যমে ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য অন্যের নাম ব্যবহার করেছেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের সহকারী একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্নার মাধ্যমে ২০০৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ২৭ লাখ টাকা এবং অন্যান্য তারিখে আরও কিছু টাকা সোনালী ব্যাংক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শাখার ওই ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে নগদ জমা করা হয়।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে জিয়াউল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ওই ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য তাকে ২৭ লাখ টাকা দিতে বলায় তার নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ওই টাকা ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে জমা করেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, চ্যারিটেবল কাজের উদ্দেশ্যে ট্রাস্টটি গঠন করা হলেও এর তহবিল থেকে কোনো ধরনের চ্যারিটেবল কাজে অর্থ ব্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং ট্রাস্টের ছয় কোটি ৫২ লাখ সাত হাজার টাকায় কাকরাইলে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়।
দলিলের বিবরণ অনুযায়ী ট্রাস্টের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি ৮৪৭১৫৬৭ নং পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমি বিক্রেতা সুরাইয়া খানকে জমির মূল্য পরিশোধ করে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। অথচ ট্রাস্টের নামে ওই জমি নামজারি (মিউটেশন) করা হয়নি। এছাড়া কোনো খাজনা বা ট্যাক্সও পরিশোধ করা হয়নি।
মামলার তদন্তে সোনালী ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শাখায় ট্রাস্টের অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে দেখা য়ায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ট্রাস্টের প্রধান হিসেবেই ওই ৩৪০৭৬১৬৫নং অ্যাকাউন্ট থেকে ১৯ জানুয়ারি ৭৯৮৬১৭১ নম্বর চেকের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি টাকা ‘ইওরসেলফ’ লিখে প্রদান করেন।
এছাড়া ৭৯৮৬১৭২ নম্বর চেকে ‘ইওরসেলফ’ লিখে ২৭ লাখ টাকা দেন। ওই টাকার চেক পাওয়ার পর ব্যাংক ব্যবস্থাপক ব্যাংক গ্রাহকের নির্দেশ অনুযায়ী ১৯ জানুয়ারি ৮৪৭১৫৬৭ নম্বর পে-অর্ডার মূলে সুরাইয়া খানের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ০১-৭৫২১১০৩-০১ নম্বর অ্যাকাউন্টে ছয় কোটি ৫২ লাখ সাত হাজার টাকা চলে যায়। ফলে সুরাইয়া খানকে দলিলের অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা অবৈধভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে বলেই প্রমাণিত হয়েছে।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানের নামে চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করে তিনি ও তার দুই ছেলে ট্রাস্টি হয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজ করেছেন।
খালেদা জিয়া সেসময় প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করেছেন। যা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।