সুখবরটা অনুমিতই ছিল, শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল বিশ্ব। অবশেষে সেই ঘোষণা দিল ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড। গতকাল সোমবার অক্সফোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) প্রতিরোধে তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি (টিকা) এখন পর্যন্ত সফল। এটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ এবং অ্যান্টিবডি তৈরি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উজ্জীবিত করে তুলতে পারে।
একই দিনে ভ্যাকসিন নিয়ে চীনও সুখবর দিয়েছে। দেশটি জানিয়েছে, তাদের তৈরি একটি ভ্যাকসিনও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি ও ‘টি-সেল’ তৈরিতে সক্ষম।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের অংশ হিসেবে এক হাজার ৭৭ জন স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। তাতে দেখা গেছে, বেশির ভাগ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে ভ্যাকসিনটি অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ‘টি-সেল’ উৎপন্ন করে। ‘টি-সেল’ হলো এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা, যেটা করোনাভাইরাসকে চিহ্নিত ও প্রতিহত করতে পারে।
ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা সম্পর্কে গতকাল বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে। সেখানে বলা হয়েছে, এটি প্রয়োগের পর মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় ‘টি-সেল’ তৈরি হতে সর্বোচ্চ ১৪ দিন সময় লাগে। আর অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সময় লাগে গড়ে ২৮ দিন।
গবেষকরা বলছেন, ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের ফলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে সেটা মারাত্মক কিছু নয়। ৭০ শতাংশের হালকা জ্বর ও মাথা ব্যথা হতে পারে। তবে সেটা প্যারাসিটামল দিয়েই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে ‘সিএইচএডিওএক্স১’ নামের একটি ভাইরাস দিয়ে। এটি ফ্লুজাতীয় ভাইরাসের একটি দুর্বল সংস্করণ। সাধারণত শিম্পাঞ্জি এই ভাইরাসে বেশি সংক্রমিত হয়। তবে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য এই ভাইরাসে জিনগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে এটি দেখতে অনেকটা করোনাভাইরাসের মতো হয় এবং মানবদেহকে সংক্রমিত করতে না পারে।
ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেওয়া অক্সফোর্ডের অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের ভ্যাকসিনটি করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম—এমনটা নিশ্চিত করে বলার আগে অনেক কাজ করতে হবে। তবে প্রাথমিক ফলের ভিত্তিতে বলতে পারি, ভ্যাকসিনটি অনেক অনেক সম্ভাবনাময়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজির অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে তা আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে এটি এখনো বিশ্বের সব দেশের মানুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর হবে কি না, সেই প্রশ্নের সমাধান হয়নি। আমি আশা করব সম্ভব হলে বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিনের একটি ট্রায়ালের ব্যবস্থা করার। এটা করতে পারলে আমরা নিশ্চিত হতে পারব, আমাদের দেশের মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিন কিভাবে কতটুকু কার্যকর হবে। কারণ অনেক ভ্যাকসিনই দেশভেদে মানুষের শরীরে বিভিন্ন মাত্রায় কার্যকর হয়।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘অক্সফোর্ডের গবেষণালব্ধ বহুল আলোচিত ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ফলাফল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, যাদের শরীরে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে নিরাপত্তার পর্যায়টিও ভালোভাবে অতিক্রম করেছে। তবে এখন পরবর্তী ধাপের ফলাফলের অপেক্ষায় আমাদের থাকতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, তবে এখনো চূড়ান্তভাবে বলার মতো পর্যায়ে যায়নি। এ ক্ষেত্রে আরো এক থেকে দেড় মাস সময় লাগতে পারে পরবর্তী ধাপ পার হতে।’
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটির নাম ‘এজেডডি-১২২২২’। ভ্যাকসিনটি উৎপাদন ও বাজারজাত করবে ব্রিটিশ ওষুধ কম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এর প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হয় গত মার্চে। কয়েকটি বানরের শরীরে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে সাফল্য পান গবেষকরা। ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের প্রথম ধাপও শুরু হয় একই মাসে। পরের মাসে প্রায় এক হাজার ১০০ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে প্রয়োগ করা হয় এটি। এরপর গত মাসের শেষ দিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হয় ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের তৃতীয় ধাপ। এই দুই দেশের প্রায় ১০ হাজার মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয় ‘এজেডডি-১২২২২’।
যুক্তরাজ্য সরকার এরই মধ্যে ১০ কোটি ভ্যাকসিনের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে চুক্তি করেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তারা অন্তত দেড় কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করবে। আরো দেড় কোটি তৈরি করবে আগামী জানুয়ারির মধ্যে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসচিব মো. আবদুল মান্নান গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে এক সভা শেষে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রটোকল অনুযায়ী অক্সফোর্ডের এই টিকা সফল হলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিনা মূল্যেই তা পাওয়ার কথা। আমাদের জায়গা থেকে আমরা সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছি।’
একটি ভ্যাকসিন সাধারণত সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। আর ভ্যাকসিন তৈরিতে মূলত অ্যান্টিজেন (সংশ্লিষ্ট ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার অংশ) ব্যবহার করা হয়। একটি ভ্যাকসিন বিশেষ ধরনের নিষ্ক্রিয় বিষাক্ত পদার্থও সরবরাহ করে, যেন সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীর একটা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, এটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না। কারণ একটি ভ্যাকসিন কোটি কোটি সুস্থ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়।
চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে একটি ভ্যাকসিনের সাধারণত দুই ধরনের পরীক্ষা হয়ে থাকে। একটি প্রি-ক্লিনিক্যাল, আরেকটি ক্লিনিক্যাল। প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে ভ্যাকসিনটি মানুষের পরিবর্তে অন্য প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এই পর্যায়ে দেখা হয়, ভ্যাকসিনটি সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে কি না। এতে সাফল্য মিললে শুরু হয় ক্লিনিক্যাল পর্যায়, অর্থাৎ মানবদেহে ভ্যাকসিনটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়।
ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে এটি অল্পসংখ্যক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হয়। এ ক্ষেত্রে গবেষকরা জানার চেষ্টা করেন, এটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না এবং সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকর। দ্বিতীয় ধাপে এটি প্রয়োগ করা হয় কয়েক শ মানুষের শরীরে। এই ধাপে গবেষকরা বোঝার চেষ্টা করেন, এই টিকা কী মাত্রায় মানুষের শরীরে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর তৃতীয় ধাপে টিকা প্রয়োগ করা হয় হাজার হাজার মানুষের শরীরে। এই ধাপে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতাসহ অন্যান্য বিষয় যাচাই করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হালনাগাদ (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ১৭০টির বেশি প্রকল্প চালু রয়েছে। এর মধ্যে প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে আছে ১৪০টি। ক্লিনিক্যাল পর্যায়ের প্রথম ধাপে রয়েছে ১৯টি। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে ১১টি। আর তিনটি ভ্যাকসিন রয়েছে তৃতীয় ধাপে। সাধারণত তৃতীয় ধাপ সম্পন্নের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মিললে একটি ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়া হয়।
ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, তৃতীয় বা চূড়ান্ত ধাপে থাকা তিনটি ভ্যাকসিনের মধ্যে এগিয়ে রয়েছে ‘এজেডডি-১২২২২’। বাকি দুটি হলো চীনের ক্যান সিনো বায়োলজিকসের ‘এডি৫-এনকভ’ এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠান মডার্নার ‘এমআরএনএ-১২৭৩’। এর মধ্যে ‘এডি৫-এনকভ’ ভ্যাকসিনটি চীনের সেনাবাহিনীতে প্রয়োগের জন্য বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
চীনের সাফল্য : ভ্যাকসিনটি পরীক্ষা চালিয়েছে জিয়াংসু প্রভিনশিয়াল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনও গতকাল ছাপা হয় ল্যানসেট সাময়িকীতে। সেখানে বলা হয়েছে, পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবককে দুটি দলে ভাগ করে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। একটি দলের সদস্যদের দেহে অধিক মাত্রায় ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয়। আরেকটি দলের সদস্যদের দেওয়া হয় কম মাত্রায়। কিন্তু উভয় দলের স্বেচ্ছাসেবকদের দেহেই অ্যান্টিবডি ও ‘টি-সেল’ তৈরি হয়। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই ভ্যাকসিন মানবদেহের ফ্লুজাতীয় দুর্বল একটি ভাইরাস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই ভ্যাকসিনেও হালকা জ্বর ও মাথা ব্যাথা ছাড়া আর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
যেকোনো টিকা বাজারজাত করা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। যেমন কয়েক দশকের চেষ্টার পর এইচআইভির ভ্যাকসিন এখন তৃতীয় ধাপে রয়েছে। ইতিহাসে সবচয়ে কম সময়ে অনুমোদন পেয়েছে মাম্পসের (পনসিকা) টিকা; চার বছরের মাথায়। তবে অনেকেই বিশ্বাস করে, উন্নত প্রযুক্তি, বিপুল অর্থ বিনিয়োগ এবং ব্যাপক গুরুত্ব পাওয়ায় ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই করোনার টিকা বাজারে আনা সম্ভব। আর সেই সম্ভাবনাকে এবার অনেকটাই বাস্তবিক করে তুলল অক্সফোর্ড।