মাইকেল জোসেপ জ্যাকসন ওয়ার্ল্ড মিউজিকের এক অবিস্মরনীয় নাম। যার অপর নাম ‘কিং অব পপ’ বা পপ সঙ্গীতের রাজা। আজ থেকে তিনবছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ জুন এমনই এক দিনে মাইকেল জ্যাকসন কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে আকস্মিকভাবে চলে যান না-ফেরার দেশে। বিশ্ব কাঁপানো এই কিংবদন্তি শিল্পীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে বাংলানিউজ ।
ছেলেবেলা
মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম ২৯ আগস্ট ১৯৫৮, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের গ্যারি নামের একটি পল্লীতে। আফ্রিকা-আমেরিকান শ্রমিকশ্রেণীর একটি পরিবারে তিনি জন্ম নেন। তার বাবা জোসেপ জ্যাকসন ছিলেন একজন গিটারিস্ট। কিন্তু তার পরিবারের সচ্ছলতার জন্য তিনি গিটার বাজানো ছেড়ে কপিকল অপারেটর হিসেবে কারখানায় যোগদান করেন।
জোসেপ জ্যাকসন তার সন্তানদের সঙ্গীত প্রতিভা বিকাশিত করার জন্য ১৯৬০ সালে একটি পারিবারিক মিউজিক্যাল গ্র“প প্রতিষ্ঠা করেন। মাইকেল জ্যাকসন পাঁচ বছর বয়সে তার ভাইদের সাথে জ্যাকসন-৫ মিউজিক্যাল গ্র“পে যোগদান করেন। শুরু থেকেই মাইকেল জ্যাকসন তার দক্ষতা ও যোগ্যতা দ্বারা দর্শকের মাঝে জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করেন। জ্যাকসন-৫ এর প্রথম মিউজিক অ্যালবাম ‘ডায়ানা রোজ’ প্রকাশ পায় ১৯৬৯ সালে এবং বছর শেষে তা টপচার্টে চলে যায় । অ্যালবামএর প্রথম একক গান ‘আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক’১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে বিলবোর্ড হট ১০০ চার্টে নাম্বার ১ পজিশনে স্থান করে নেয়।
সলো ক্যারিয়ার
মাইকেল জ্যাকসন এর সলো ক্যারিয়ার শুরু হয় যখন তার বয়স ১৩ বছর। ১৯৭১ সালে তিনি ‘গোট টু বি দেয়ার’ শিরোনামের একটি গান বের করেন । ১৯৭২ সালে ‘বেন’ অ্যালবামটি তার প্রথম একক অ্যালবাম। ১৯৭১-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মাইকেল জ্যাকসন তার ফ্যামিলি ব্যান্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এরপর তার পরবর্তী অ্যালবাম বের হয় ১৯৭৯ সালে ‘অফ দ্যা ওয়াল’ নামে। এই অ্যালবামের ‘ডোন্ট স্টপ টিল ইউ গেট অ্যানাফ’, ‘রকিং উইট ইউ’ সুপারহিট হয় এবং জার্মানির মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। মাইকেল জ্যাকসনের সলো ক্যারিয়ারে সফল হতে যে অ্যালবামটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা হলো ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘ট্রিউমপ’ অ্যালবামটি, যার এক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। এরপর তার ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘থ্রিলার অ্যালবামটি টপ লিস্টে জায়গা করে নেয়।
চলচ্চিত্রে মাইকেল
মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘দ্য উইজ’। মিউজিক্যাল এই মুভিতে এক কাকতাড়ুয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ওই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই মিউজিক্যাল মুভিটি অবশ্য বক্স অফিসে ছিল ফ্লপ।
এর আট বছর পর ১৯৮৬ সালে আবারও ফিরে এলেন হলিউডে। এবার ক্যাপ্টেন ‘ইও’-র নাম ভূমিকায়। থ্রি-ডি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ছিল স্পেশাল ইফেক্টনির্ভর। ছিল ব্যবসাসফলও। মাইকেল মারা যাওয়ার পর আবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্যাপ্টেন ইও। ডিজনিল্যান্ডে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বসেছে ‘ক্যাপ্টেন ইও’এর অ্যাডভেঞ্চার থিয়েটার।
১৯৮৮ সালে বের হয় ‘মুনওয়াকার’। এটাকে চলচ্চিত্র না বলে মিউজিক ভিডিওর কালেকশনও বলতে পারেন। যার নামকরণ করা হয় পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে যাওয়ার সেই বিখ্যাত ড্যান্সস্টেপ মুনওয়াক থেকে। এর প্রায় নয় বছর পর ১৯৯৭ সালে মাইকেল অভিনয়ে ফেরেন হরর চরিত্রে। ছবির নামও সেরকম ‘ঘোস্ট’। এটাকে আসলে বড়সড় একটা মিউজিক ভিডিও।
এছাড়াও জ্যাকসন অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘মেন ইন ব্ল্যাক টু’, ‘মিস কাস্ট অ্যাওয়ে অ্যান্ড দ্য আইল্যান্ড গার্লস’ প্রভৃতি ছবিতে।
ক্যারিয়ারের খারাপ সময়
সব শিল্পীর মতোই মাইকেল জ্যাকসন তার ক্যারিয়ারের খারাপ সময় পার করেছেন অনেকবার। ১৯৯৩ সালে প্রথমবার একটি বালক জ্যাকসনের বিরুদ্বে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন। তবে এ বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করে কোন প্রমাণ পায়নি। পরবর্তী বছর মাইকেল জ্যাকসন আদালতে গিয়ে বিষয়টি সুরাহা করেন।
বিবাহিত জীবন
১৯৯৪ সালের আগস্ট এ মাইকেল জ্যাকসন ঘোষনা করেন তিনি লিসা মেরি প্রিসকে বিয়ে করেছেন। তবে এই বিয়ে বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। ১৯৯৬ সালেই তাদের মাঝে ডিভোর্স হয়ে যায়। অনেকে অবশ্য তাদের এই বিয়েকে নিছক তার বিরুদ্ধে আনা শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগকে ধামা-চাপা দেয়ার হাতিয়ার হিসেবেই দেখেন।
একই বছরে মাইকেল জ্যাকসন ডেবির নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন। তাদের কৃত্রিম উপায়ে দুটি সন্তান হয়। যাদের মধ্যে ছেলে প্রিন্স মাইকেল জ্যাকসন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৭ সালে এবং মেয়ে প্যারিস মাইকেল জ্যাকসন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৮ সালে। ডেবির এর সাথেও মাইকেল জ্যাকসন এর ডিভোর্স হয়ে যায় ১৯৯৯ সালে।
জীবনাবসান
২০০৯ সালের ২৫ জুন মাইকেল জ্যাকসন হঠাৎ করেই ওভারডোজ মেডিসিনের কারণে কার্ডিয়াক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে তার লস অ্যানজেলসের বাড়িতে অচেতন হয়ে পড়েন। তারপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে অচেতন অবস্থাতেই পরদিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৫০ বছর। অকালে এই মহান শিল্পী চলে যাওয়ার পর ঝড় উঠে তার মৃত্যুরহস্য অনুসন্ধান নিয়ে। পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের অকাল মৃত্যুর জন্য তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কনরাড মারের ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করা হয়।
স্তব্ধ পৃথিবী
দাবানলের মতো সারা বিশ্বে ২০০৯ সালের ২৫ জুন ছড়িয়ে পড়ে ‘কিং অব পপ’ মাইকেল জ্যাকসন আর নেই। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। সত্যতা জানতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিভি চ্যানেল আর ইন্টারনেটে। সবাই একসঙ্গে ব্রাউজ করায় ওয়েবট্রাফিকে পড়ে অস্বাভাবিক চাপ। অপ্রত্যাশিত এত ব্যবহারকারী দেখে গুগল ধরেই নেয় তাদের সার্চ ইঞ্জিনে কেউ হামলা করেছে! ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার, ইউটিউব, উইকিপিডিয়াসহ অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের সার্ভার ক্রাশ করে। প্রতি মিনিটে ছয় হাজারের বেশি টুইটসের চাপ নিতে পারেনি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটার। ৪০ মিনিট ওয়েবসাইটটি ছিল ক্রাশড অবস্থায়। জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো তাদের দিনের ৩৪ শতাংশ সময় বরাদ্দ করে জ্যাকসন স্পেশাল অনুষ্ঠানের জন্য। এমটিভি একের পর এক প্রচার করতে থাকে জ্যাকসনের মিউজিক ভিডিও। হলিউডের ওয়াক অব ফেম ভরে ওঠে ভক্তদের ফুল আর শ্রদ্ধায়।
মাইকেলের শেষ প্রজেক্ট
মাইকেলের শেষ চলচ্চিত্র ‘মাইকেল জ্যাকসনস দিস ইজ ইট’। দীর্ঘদিন পর কনসার্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ‘দিস ইজ ইট’ শিরোনামের সেই কনসার্টের প্রস্তুতি নিয়ে মাইকেলের পরিকল্পনা ছিল একটি চলচ্চিত্র করার। কিন্তু মাঝপথেই চিরতরে থেমে গেলেন মাইকেল। থেমে গেল ‘দিস ইজ ইট’। মাইকেল মারা যাওয়ার পর শুট করা ফুটেজ জোড়াতালি দিয়েই তৈরি করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রটি। মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলারের ছবিটি আয় করে ২৬০ মিলিয়ন ডলার। রেকর্ড গড়েছে মাইকেলের জীবনের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে।
এক নজরে মাইকেল জ্যাকসন
পুরো নাম : মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন
অন্য নাম : মাইকেল জো জ্যাকসন
বাবার নাম : জোসেপ জ্যাকসন
জন্ম : ২৯ আগস্ট ১৯৫৮ (গ্যারি, ইন্ডিয়ানা)
মৃত্যু : ২৫ জুন ২০০৯ (লস অ্যানজেলস, ক্যালির্ফোনিয়া)
উচ্চতা : ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি
উপাধি : কিং অফ পপ
সেরা পাঁচ অ্যালবাম
১. জ্যাকসন ফাইভ আলটিমেট কালেকশন (১৯৯৬)
২. অফ দ্য ওয়াল (১৯৭৯)
৩. দ্য জ্যাকসনস ট্রিউম্ফ (১৯৮০)
৪. থ্রিলার (১৯৮২)
৫. ব্যাড (১৯৮৭)
সেরা পাঁচ মিউজিক ভিডিও
১. স্ক্রিম/চাইল্ডহুড (১৯৯৫)
২. বিট ইট (১৯৮৩)
৩. থ্রিলার (১৯৮৩)
৪. স্মুথ ক্রিমিনাল (১৯৮৮)
৫. রিমেম্বার দ্য টাইম (১৯৯২)
সেরা দশ গান:
১. বিলি জিন
২. বিট ইট
৩. দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস
৪. আর্থ সং
৫. ম্যান ইন দ্যা মিরর
৬. স্মুথ ক্রিমিনাল
৭. থ্রিলার
৮. হিল দ্যা ওয়াল্ড
৯. ব্লাক অর হোয়াইট
১০. ডার্টি ডায়ানা