৪৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের এক বছরে নিট লোকসান ১৬,৮৮০ কোটি টাকা

৪৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের এক বছরে নিট লোকসান ১৬,৮৮০ কোটি টাকা

গত এক বছরে ৪৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নিট লোকসান বেড়েছে দ্বিগুণ। বিদায়ী (২০১১-১২) অর্থবছরে লাভ-লোকসান মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮৮০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে (২০১০-১১) এ প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান ছিল ৮ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।

সরকারের বাজেট উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত দশ বছরের মধ্যে মাত্র দু’বার (২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছর) লাভ-লোকসান মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিট মুনাফা অর্জন করেছিল। এর মধ্যে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২৭৭৬ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু এবারসহ গত দু’বছর ধরে আবারো লোকসান গুণতে হচ্ছে সরকারকে এবং গত এক বছরে লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ।

বিদায়ী অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, সেবা, পরিবহন যোগাযোগ, বাণিজ্যিক, কৃষি ও মৎস্য, নির্মাণ এবং সার্ভিসসহ অন্যান্য খাতের মোট ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়েছে। এগুলোর মোট লোকসানের পরিমাণ হচ্ছে ২৫ হাজার ২৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে বাকি ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মোট মুনাফার পরিমাণ ৮ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের মুনাফার প্রায় তিনগুণের সমান হচ্ছে ১২টির লোকসান। ফলে লাভ-লোকসান মিলিয়ে সরকারের নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮৮০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

লোকসানের শীর্ষে বিপিসি ও পিডিবি
মাত্র দশটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানের কারণে প্রতিবছর বিপুল অংকের অর্থ লোকসান দিতে হচ্ছে সরকারকে। গত দশ বছরে দুয়েকবার এ প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা অর্জন করলেও মূলত: লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে রয়েছে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন’ (বিপিসি) এবং এর পরেই রয়েছে ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ (বিপিডিবি)। বিদায়ী অর্থবছরে বিপিসি ও পিডিবি আগের অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ লোকসান দিয়েছে। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দরের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্যের সমন্বয় না থাকায় এ দুই প্রতিষ্ঠানের লোকসান বেড়েছে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানায়।

প্রসঙ্গত: নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। সে সময় বছরে এগুলোর গড় লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ক্রমশ: বেসরকারিকরণ ও অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে এ খাতে সরকারের লোকসান বছরে ৫শ’ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।

বহুল আলোচিত বিজেএমসির আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো দীর্ঘ সময় লোকসানের পর গত দু’বছর (২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছর) ধরে মুনাফা অর্জন করছে। এর মধ্যে ২০১০-১১ ও বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে বিজেএমসি যথাক্রমে ১৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং ২৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিজেএমসির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ২২০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। অবশ্য চলতি অর্থবছরে বিজেএমসির পুঞ্জিভূত ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পরিশোধ করেছে সরকার।

বিপিসি: বিদায়ী অর্থবছরে বিপিসির লোকসান ১৬ হাজার ৮১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে (২০১০-১১) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮৪০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান দিয়েছিল ২ হাজার ৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর আগের বছর (২০০৮-০৯) প্রতিষ্ঠানটি ৩২২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করলেও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

পিডিবি: বিদায়ী অর্থবছরে পিডিবির লোকসান হিসাব করা হয়েছে ৮ হাজার ৪৩১ কোটি ১২ লাখ টাকা। গত বছর (২০১০-১১) লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। আর এর আগের বছর (২০০৯-১০) লোকসান দিয়েছিল ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। গত দশ বছরে পিডিবি মুনাফা অর্জন করেছে মাত্র একবার।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি): গত তিন বছর ধরে বিএসএফআইসির লোকসান একটু একটু করে বাড়ছে। বিদায়ী অর্থবছরে বিএসএফআইসির লোকসান হিসাব করা হয়েছে ১৯৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত বছর (২০১০-১১) প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছিল ১৭০ কোটি টাকা। এর আগের বছর (২০০৯-১০) লোকসান দিয়েছিল ১২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি): ২০০৯-১০ অর্থবছরে একবার লাভের মুখ দেখলেও ক্রমশ: লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে আরইবি। ওই বছর আরইবি মুনাফা অর্জন করেছিল ৩৪৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কিন্তু এর আগের বছর (২০০৮-০৯) ও পরের বছর (২০১০-১১) প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৪৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং ১৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের চেয়ে লোকসান কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে আরইবির লোকসান ধরা হয়েছে ১৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি): বিদায়ী অর্থবছরে বিসিআইসির লোকসান হিসাব করা হয়েছে ১৫৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর আগে ২০১০-১১ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছিল যথাক্রমে ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং ২৬১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি): প্রতিবছর বিআরটিসির লোকসানও বেড়ে চলেছে। বিদায়ী অর্থবছরে বিআরটিসির লোকসান ধরা হয়েছে ৯৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর আগে ২০১০-১১ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছিল যথাক্রমে ৬২ কোটি ৬ লাখ টাকা এবং ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

অন্যান্যের মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন’ (বিটিএমসি) ২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিহন কর্তৃপক্ষ’ (বিআইডব্লিউটিএ) ১৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, বিএফএফডব্লিউটি ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা ও ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন’ (বিএফডিসি) ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

এছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আরো দু’টি নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ‘যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ’ (জেএমবিএ) এবং  ‘রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো’ (ইপিবি)। এ বছর জেএমবিএর লোকসান ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গত বছর (২০১০-১১) এবং এর আগের বছর (২০০৯-১০) প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও ৯৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

অন্যদিকে ইপিবির লোকসান হিসাব করা হয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। গত বছর (২০১০-১১) এবং এর আগের বছর (২০০৯-১০) প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ও ৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ