মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডু এলাকায় জাতিগত সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে বলে স্বীকার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ব্যাপক চেষ্টা থাকলেও তাদের নজর এড়িয়ে অনেক রোহিঙ্গা নাগরিকই ঢুকছে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায়।
বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা অনেককে আটক করার পর পুশব্যাক করলেও তারা মিয়ানমারে ফিরতে পারছেন না। তিন-চারদিন ধরে সাগরে ভাসতে ভাসতে তারা ঠিকই এদেশীয় দালালচক্রের মাধ্যমে গোপন রুট দিয়ে প্রবেশ করছে টেকনাফে।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারার কথা স্বীকার করে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই যে, এই বিশাল সীমান্ত এলাকা পাহারা দিয়ে রাখতে পারব। বিজিবি সদস্যরা দিনরাত চেষ্টা করছেন, কোস্টগার্ডও আছে। কিন্তু হাতে হাত ধরে সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা তো সম্ভব না। এজন্য কেউ কেউ দালালের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে।’
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত সময়ে টেকনাফ দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী নাফ নদীতে ভাসমান চারটি ট্রলারে করে আসা ১১৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়েছে।
এর মধ্যে রাত ১২টার দিকে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ এলাকার বদরমোকাম পয়েন্টে ভাসমান ট্রলার থেকে কঙ্কালসার এক শিশু, রাত দু’টায় ঘোলাপাড়া পয়েন্ট থেকে ৪৪ জন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে ৩৯ জন এবং সকাল ৮টায় বদরমোকাম এলাকা থেকে ৩০ জনকে আটক করা হয়েছে।
এর মধ্যে শিশুটিকে স্থানীয় এক জেলের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে। সেন্টমার্টিন এবং বদরমোকাম থেকে আটক করা ৬৯ জনকে পুশব্যাক করা হয়েছে। এছাড়া ঘোলাপাড়া পয়েন্ট থেকে আটক ৪৪ জনের ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় তাদের পুশব্যাক না করে আটক করে রাখা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ঘোলাপাড়া পয়েন্টে আটক ৪৪ জনকে গত রোববার বদরমোকাম এলাকা থেকে ধরে পুশব্যাক করা হয়েছিল। তখন ওই ট্রলারে রোহিঙ্গা নাগরিক ছিল ৪৭ জন। বাকি তিনজন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে সক্ষম হয়েছে বলে আটক লোকজন জানিয়েছেন।
ওই ট্রলারের যাত্রী হোসনা বেগম জানান, রোববার স্বামী ও চার সন্তানসহ তাদের পাড়ার মোট ৪৭ জন মিলে মিয়ানমারের আকিয়াবের গোয়াইল্যাঢিলা গ্রাম থেকে ট্রলারে করে রওনা দেন। কিন্ত ফেলে আসেন তার বৃদ্ধা মাকে। রোববার বিকেলে তাদের বদরমোকাম এলাকা থেকে বিজিবি ধরে পুশব্যাক করার পর থেকে তারা চারদিন ধরে সাগরে ভাসছে।
এর মধ্যে বিভিন্ন সময় জিঞ্জিরাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে তারা ঢোকার চেষ্টা করলেও বিজিবির বাধায় তারা বাংলাদেশে ঢুকতে পারেননি বলে হোসনা বেগম জানান।
ওই ট্রলারের মাঝি ফারুকসহ কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, জিঞ্জিরা পয়েন্ট দিয়ে রোববার রাতে এক শিশুসহ তিনজন স্থলে নেমে গেছে। তারা টেকনাফের ভেতরে ঢুকেছে।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, যে তিনটি ট্রলার তারা আটক করেছেন সেগুলো গত চারদিন ধরে সাগরে ভাসছে। এভাবে অনুপ্রবেশের জন্য সাগরে ৭ থেকে ৮টি ট্রলার ভাসছে। কয়েকটিকে পুশব্যাক করা হলেও ভয় আর আতংকে তারা মিয়ানমারে ঢুকতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রলারে তেল থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা অনুপ্রবেশের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাদের কাছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিকল্প কিছু নেই।’
এর আগে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ এলাকায় মিয়ানমার থেকে আসা একটি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারা বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে টেকনাফে প্রবেশ করেন এবং স্থানীয় এক ইমামের বাসায় আশ্রয় পান।
সূত্র জানায়, টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতি আছে। এজন্য অনেক স্থানীয় মাঝিমাল্লাও তাদের ছদ্মবেশে, জেলে আর মাঝিমাল্লার বেশে টেকনাফে অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছেন।
বুধবার বদরমোকাম, ঘোলাপাড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের ট্রলারগুলোর জন্য স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, ওরস্যালাইন, ওষুধ দেয়া হচ্ছে। আর এলাকার মানুষের সহযোগিতায় বিজিবি ও কোস্টগার্ড দিচ্ছে ত্রিপল আর নৌকার জ্বালানী তেল।
ঘোলাপাড়া এলাকায় আটকে পড়া ৩০ জনকে ওই এলাকার স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে ভাত রান্না করে খাওয়াতে দেখা গেছে।
বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নাফ নদীতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সীমান্ত পাহারায় বিজিবির ৮২০ জন সদস্য মোতায়েন থাকে। কোস্টগার্ডেরও থাকে প্রায় ২০০ জন।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিজিবির ১২০ জন এবং কোস্টগার্ডের ১০০ জন অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
টেকনাফের ৪২ ব্যাটেলিয়ন বিজিবির অপারেশন অফিসার ক্যাপ্টেন এইচ কামরুল হাসান বলেন, ‘অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েনের পরও রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ঠেকাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ নদীপথ হলেও টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে নৌকা বা ট্রলার ভেড়ানো সম্ভব। এত বিশাল এলাকা তো পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’
এদিকে বুধবার থেকে নাফ নদীতে সীমান্তরেখার আশপাশ দিয়ে বাংলাদেশি ট্রলারের মাছ ধরা ট্রলারসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘কেয়ারি গ্রুপের যেসব জাহাজ সীমান্ত রুটের পাশ দিয়ে সেন্টমার্টিন যায় তাদের আপাতত জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখতে বরেছি। মাছ ধরা ট্রলারগুলো অনেক সময় সীমান্ত পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে ফেলে। যেহেতু অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে, তাই তাদের আপাতত সীমান্তের আশপাশের এলাকা দিয়ে চলাচল করতে নিষেধ করেছি।’