একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীর আইনজীবী দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের’ প্ররোচণায় সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর আসামিপক্ষের জেরার জবাবে সাক্ষী সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি বলেছেন, আসামিপক্ষের এ বক্তব্য সঠিক নয়।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ আসামিপক্ষ মঙ্গলবার সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সিরু বাঙালিকে জেরা শেষ করেছে। গত ২৭ মে থেকে শুরু হওয়া এ জেরা ৫ কার্যদিবসে এসে সম্পন্ন হলো। এর আগে ২৪ ও ২৭ মে সিরু বাঙালি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।
আসামির কাঠগড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে জেরায় আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী আহসানুল হক বলেন, একটি মহল আশ্বাস দিয়েছে যে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সাক্ষীকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়া হবে। এই আশ্বাসের ভিত্তিতে সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে সিরু বাঙালি বলেন, এটা সত্য নয়।
আহসানুল হক মত (সাজেশন) দেন, সাকা চৌধুরীর প্রতিপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকে সংসদ থেকে দূরে রাখতে এই মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন এবং সাক্ষীকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াচ্ছেন। এ মতেরও বিরোধিতা করেন সাক্ষী।
আইনজীবী বলেন, ক্যাপ্টেন করিম ও বিভূতির নামে সালাউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে আদালতে যে সাক্ষ্য সাক্ষী দিয়েছেন, তা অসত্য ও তদন্ত কর্মকর্তার শিখিয়ে দেওয়া। সাক্ষী এরও বিরোধিতা করে বলেন, এটা সত্য নয়।
তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি ও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দানকালে মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি ক্যাপ্টেন করিম ও বিভূতি নামের দুই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই দু’জনের কাছে তিনি নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সাকা চৌধুরীর জড়িত থাকার বিষয়টি জেনেছেন।
জেরার শেষ দিকে আহসানুল হক জানতে চান, সাক্ষী ও সালাউদ্দিন কাদের দুইটি ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন কি না। জবাবে সাক্ষী ‘হ্যা’সূচক জবাব দেন। এ সময় সাক্ষী আরো বলেন, একাত্তরে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে আর সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন।
সিরু বাঙালিকে প্রায় দেড় ঘণ্টা জেরা করেন আহসানুল। মামলার চতুর্থ সাক্ষী শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ গৌরাঙ্গ সিংহকে জেরার জন্য ১৮ জুন দিন ধার্য করা হয়েছে। তিনি গত ৪ জুন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিলেও তাকে এখনো জেরা শুরু করেনি আসামিপক্ষ।
উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত সিরু বাঙালি ও গৌরাঙ্গ সিংহ ছাড়াও বাংলা একাডেমির সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ।
এর আগে ৩ মে ও ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটম্যান) উপস্থাপন সম্পন্ন করে।
২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যুষে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত দল। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন।
৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ।