পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা: দীপু মনি বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কিছু করবে না, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাসে বাংলাদেশ আস্থা রাখতে চায়। কারণ একটি দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে দেওয়া আনুষ্ঠানিক এমন লিখিত আশ্বাসের প্রতি আস্থা রাখাই কূটনৈতিক শিষ্টাচার বলে আমরা মনে করি।
গত মঙ্গলবার ব্রিটেনের লেস্টার শহরের ডি মন্টফর্ট ইউনিভার্সিটিতে ‘হিংস্র মৌলবাদের শেকড়’ শীর্ষক এক সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই মন্তব্য করেন।
টিপাইমুখ ইস্যুতে ভারত তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা না করে তাহলে বাংলাদেশ কি করবে, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে দীপু মনি উপরোক্ত মন্তব্য করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর এবং সর্ব সাম্প্রতিক আবার ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রতিশ্রুতির পর অবশ্যই এ বিষয়ে আমাদের আস্থা রাখা উচিত।
তিনি বলেন, এরপরও যদি ভারত তার প্রতিশ্রুতি না রাখে, তাহলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবশ্যই তার করণীয় থেকে পিছুপা হবে না। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ সম্ভব সব কিছুই করবে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আমরা পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট রেখেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গিয়েছিলাম। সুতরাং কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ তার অধিকার রক্ষায় প্রতিবেশির সঙ্গে সম্পকর্ক অটটু রেখেও সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিতে পারে, এটি দোষের কিছু নয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বিরোধী দলের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটি নতুন কোনো ইস্যু নয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা সামনে রেখে টিপাইমুখ ইস্যু আলোচিত হয়ে আসছে। অথচ বিরোধী দল জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এই ইস্যু নিয়ে এমনভাবে সমালোচনা করছে যেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই এই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই পরযন্ত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ৩৭টি বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলেই হয়েছে ১৩টি। ৯১ থেকে ৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি ও বিএনপি-জামাত জোটের শাসনামলের মোট ১০ বছরে যৌথ নদী কমিশনের সর্বমোট এই বৈঠক হয়েছে মোট ৪টি।’
‘এই বৈঠকগুলোতে টিপাইমুখ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপিত হলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদই করেনি। বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দুই দুই বার ভারত সফর করেছেন। কিন্তু দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে প্রচারিত যৌথ প্রেস রিলিজের কোথাও টিপাইমুখ শব্দটি দেখা যায়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের দুই মেয়াদে এখন পর্যন্ত যৌথ নদী কমিশনের প্রায় আটটি বৈঠক হয়েছে, হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পরযায়ের বৈঠক। প্রায় প্রতিটিতে টিপাইমুখ ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারই একমাত্র ভারত থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে যে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, টিপাইমুখে এমন কিছু করবে না ভারত। এরপরও আমরা যৌথ সমীক্ষার কথা বলেছি। এই সমীক্ষায় যদি দেখা যায় এই প্রকল্পে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না, বরঞ্চ এতে অংশ নিলে আমাদের লাভ হবে, তাহলে টিপাইমুখ প্রকল্পে অংশ নেওয়ার কথাও চিন্তা করতে পারে বাংলাদেশ।’
পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্তী মমতা ব্যানার্জির সাথে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি দুটো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিষয়। মমতা ব্যানার্জি ভারতের একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে, তবে এই সহযোগিতা কিভাবে আদায় করা হবে তা ভারতের কেন্দ্র্রীয় সরকারের মাথাব্যথার বিষয়। বাংলাদেশের যতো নেগোসিয়েশন সব হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। কুটনৈতিক রীতি অনুযায়ী এটিই নিয়ম।’
তাহলে মমতার সঙ্গে তার সাম্প্রতিক সাক্ষাতের কারণ কী এমন প্রশ্নের উত্তরে দীপু মনি বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে এক ইমোশনাল সম্পর্ক। মমতাও বাংলাদেশকে খুব আপন হিসেবে ভাবেন। এক্ষেত্রে মমতার সঙ্গে সৌজন্য বৈঠক হতেই পারে। আর দুই রাজনীতিকের মধ্যে বৈঠক হলে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তো হতেই পারে, এটি কোনো দোষের বিষয় নয়। মমতার সঙ্গে বৈঠক তিস্তা নিয়ে কোনো নেগোসিয়েশনের অংশ নয়।’
তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দীপু মনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই বলে আসছি এই চুক্তির বিষয়ে আমরা আশাবাদী। কোনো একটি চুক্তি হবেই হবে, এমন করে বলার কোনো সুযোগ নেই।‘
গঙ্গা চুক্তির শর্ত মতে বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পানি ভাগাভাগি হয় পানির পরিমাণের ওপর। যতটুকু পানি পাওয়া যায়, ততটুকুই হবে ভাগাভাগি, এটিই তো স্বাভাবিক। যে সময় যে পরিমাণ পানি থাকে সে অনুযায়ীই বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে।পানি কারো একার সম্পত্তি নয়। জীববৈচিত্র এমনকি নদীরও অধিকার আছে পানির ওপর। সবার অধিকার অনুযায়ী যার যার হিস্যা তো দিতেই হবে।’
মৌলবাদ মেকাবেলায় ব্রিটেনের হোম এফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির সেমিনারে বাংলাদেশের কী অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উগ্র জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যই এই সেমিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগত ভাবেই অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী। বিগত বিএনপি-জামাত জোট আমলে বাংলাদেশকে যেভাবে জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য করা হয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে দেশটিকে বের করে নিয়ে আসা বর্তমান সরকারের জন্যে কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ছিল সন্দিহান। কিন্তু ক্ষমতা নেওয়ার মাত্র তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করে শেখ হাসিনার সরকার প্রমাণ করেছে, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও আন্তরিকতা থাকলে সবকিছুই সম্ভব।’
বাংলাদেশ থেকে হিংস্র মৌলবাদ বিতারণের পন্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দীপু মনি বলেন, ‘সমাজের সমস্যা সংকট এসব কিছু এক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করেই এধরনের সমস্যা মোকাবেলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দীর্ঘ অনুপস্থিতি জঙ্গিবাদ উত্থানের অন্যতম একটি কারণ। বিগত সরকারগুলো তাদের দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে জঙ্গিবাদকে বিস্তৃত হতে সহযোগিতা করেছে। এমন কি বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গি নেতার ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সম্পর্কেও চোখ বন্ধ রেখে তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার বলেছে বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি।’
গত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাভাই ও শায়খ আবদুর রহমানের শাস্তির রায় বাস্তবায়নের আগে তাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়ার সমালোচনা করে দীপু মনি বলেন, তাদের কথা বলতে দিলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কে অনেক কিছু বেরিয়ে আসতো। আমরা চাই না, আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক সমাজ চেতনা কেউ ধ্বংস করুক, আমাদের ভূমিকে ব্যবহার করে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্র্রে জঙ্গি তৎপরতা পরিচালিত হোক। বিগত তিন বছরে আমাদের সরকার এই কমিটমেন্ট থেকেই জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করেছে। আর তাই পুরো দক্ষিণ এশিয়াই আজ জঙ্গি ঝুঁকি থেকে অনেকটা মুক্ত। জনগণের সমর্থন, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ এবং আইনের সঠিক প্রয়োগই বাংলাদেশ থেকে হিংস্র মৌলবাদ নির্মূলে বর্তমান সরকারকে সফল করেছে। আর এ বিষয়গুলোই ব্রিটেনের হোম এফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির সেমিনারে আমি বলেছি।’
সাম্প্রতিক সময়ে হিংস্র মৌলবাদের সঙ্গে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের কারও কারও সম্পৃক্ততা বিষয়ে লেস্টার সেমিনারে হোম এফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির চেয়ার কিথ ভাজ এমপির একটি মন্তব্য সম্পর্কে দীপু মনির দৃষ্টি আকর্ষণ করে লানিউজের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়।ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মের কারও কারও বিরুদ্ধে হিংস্র মৌলবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে, এর দায় কার? ব্রিটেনের না বাংলাদেশের? উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বেই জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটছে। এই অভিযোগ এই প্রসারেরই অংশ। কেন এমন ঘটছে ব্রিটেনের হোম এফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটি তো এগুলোর কারণ খুঁজতেই তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে।’
‘ব্রিটিশ-বাংলাদেশি তরুণদের মৌলবাদের সঙ্গে সম্পৃক্তি কোনো একক রাষ্ট্র বা ধর্মের দায় রয়েছে, এভাবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। এটি সারা বিশ্বে বিস্তৃত হিংস্র মৌলবাদেরই একটি অংশ। ব্রিটেন ও বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কেই এর কারণ খুঁজতে হবে। আর জঙ্গিবাদ নির্মূলের বর্তমান বিশ্ব উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশও একযোগে কাজ করতে চায়’।
ব্রিটেনে বসবাসরত চিহ্নিত দুই যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় নেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে ট্রাইবোনাল গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাইবোনাল যাকে যে সময় বিচারের আওতায় নিতে চাইবে, সরকার এ বিষয়ে তাদের সব ধরনের সহযোগিতাই করবে।’
সম্প্রতি বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টে ২০০১ সালে সংখ্যালঘু নিরযাতনের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র্রমন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার হাতে হাত ধরে চলে। একটি ছাড়া আরেকটি অচল। বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখতে হলে সব ধরনের অপরাধের বিচার অবশ্যই করতে হবে। ২০০১ এর নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু নিরযাতনের সঙ্গে জড়িতরাও বিচারের বাইরে থাকতে পারবে না। কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি অঙ্গীকার।’