মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতিবিদদের ঘুম হারাম হয়ে গেলেও বিচক্ষণ ও সংযত মুদ্রানীতির কারণে তা স্বস্তিদায়ক এক অঙ্কে নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি অর্থনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালবেন না। সংশয়বাদীদের আশঙ্কার ভিত্তি কোথায় আমি জানি না।’
তিনি বলেন, ‘গত মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। আশা করছি, এ ধারা কমতির দিকেই থাকবে। সবচেয়ে স্বস্তির কথা এই যে, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভুত উভয় ধরনের মূল্যস্ফীতিই কমতে শুরু করেছে। মে মাসে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মনস্তাত্তি¡কভাবে মূল্যস্ফীতি কমছে, ধরে নিয়ে মানুষ ঘরে ফিরলে পরদিন দুই কেজি চাল কম কিনবেন। এতে চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমবে।
শনিবার দুপুরে চট্টগ্রামে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) আয়োজিত ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক আঞ্চলিক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। আমদানির চাপ কমার সূত্রে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারেও এখন স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। অপরদিকে রফতানি প্রবৃদ্ধিও এমন দুঃসময়ে খারাপ নয়। এ কথা ঠিক গত বছরের চেয়ে এবার রফতানির পরিমাণ কম হলেও টোটাল ফিগার অনেক বড়। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির অঙ্ক বড় হয়ে যায়। এ সময় টাকার দাম উঠতে থাকে। যদিও ভারতের অবস্থা আরো খারাপ ছিল। এর জন্য আমাদের সংযত মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হয়েছিল। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল। যা ভারতে হচ্ছে না।’
রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স প্রবাহ ১২ শতাংশের মতো হারে প্রবৃদ্ধির কারণে আমরা আশা করছি, চলতি অর্থবছর শেষে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স দেশে আসবে। জুনের শেষে এটা হবে একটি রেকর্ড। আমদানি ব্যয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্তে¡ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে। এপ্রিলের শেষ দিকে ছিল ১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। শুক্রবার ছিল ৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এটা ১০ বিলিয়নের আশপাশে ঘুরছে। তিন বছর আগে ছিল ১০ বিলিয়নের অর্ধেক।’
‘অর্থনীতিবিদেরা প্রবৃদ্ধির অঙ্ক নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ভারতের পরই আমাদের অবস্থান। এটা গুণমানের প্রবৃদ্ধি। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের ১১তম দেশ আমরা। আমাদের অর্থনীতিতে ঝুঁকি নেই, এটা বিদেশিদের কথা। কয়েক দিন আগের বিশ্ব ব্যাংকের সূচক অনুযায়ী ভারতের ওপরে আমাদের অবস্থান।’
সংকট উত্তরণের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যে হারে রাজস্ব আহরণ করবেন, তার চেয়ে বেশি হারে উন্নয়নের জন্য টাকা দেবেন না। মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় করার লক্ষ্যে আমরা তখন সরকারকে বলেছিলাম, আর ঋণ নেবেন না।’
নিজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু কথা বলার গভর্নর নই। যা বলি তা বাস্তবায়ন করি। আমার সহকর্মীদের জন্যও এটি প্রযোজ্য। তাদের বলতে চাই, আমার মুখ দিয়ে যদি বলান, তা যতই কষ্টের হোক করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এমআরএ’র চেয়ারম্যান ড. আতিউর রহমান বলেন, এমআরএ এ পর্যন্ত ৬৪৩টি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সনদ দিয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৬ জেলায় ৭৮টি প্রতিষ্ঠান ১৮ লাখ দরিদ্র মানুষের মধ্যে ১২ লাখ মানুষকে সদস্য করতে পেরেছে। এটা বিরাট অর্জন। সারা দেশে ১০০টির মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকগুলো তহবিল সরবরাহ করেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৩টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে ৩৪ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যা প্রয়োজন ও সুযোগের তুলনায় এখনো খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে তিনি দেশে আদা, রসুন ও পেঁয়াজের মূল্য স্থিতিশীল থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের কৃষকের আদা, রসুন ও পেঁয়াজের বাম্পার ফলন ঘটিয়েছেন। যদিও প্রথম দিকে বাজারজাতকরণের অভাবে তারা ন্যায্যমূল্য পাননি। পরে এদিকে নজর দেওয়া হয়েছে। এবার বাজার মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও এটা ভূমিকা রেখেছে।
ড. আতিউর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন, এখনো ব্যাংকগুলোর মধ্যে যারা নির্দিষ্ট অঙ্কের কৃষিঋণ বিতরণের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি, তাদের জন্য সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। নইলে ১ জুলাইয়ের পর নির্ধারিত টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কেটে নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ইসলামী ব্যাংকগুলোকে লাভ বা মুনাফা যে কোনো নামেই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন রিফাইন্যান্স নিয়ে গরিব মানুষের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানান।
তিনি আলোচনা সাপেক্ষে ব্যাংকারদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মকাণ্ডে (সিএসআর) দেখানোর সুযোগ দিতে রাজি আছেন বলে অভিমত দেন।
নগরীর ষোলশহর এলজিইডি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকারদের সঙ্গে আঞ্চলিক মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক অধ্যাপক হান্নানা বেগম ও বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. মাসুম কামাল ভূঁইয়া।
ড. খলিকুজ্জামানের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক হান্নানা বেগম বলেন, বর্তমানে ৬৪৩টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ৩ কোটি সুবিধাভোগীর কাছে ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এমআরএ নীতিমালার প্রতিটি নীতিই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অনুমোদিত হয়েছে। তাই সবাইকে নিয়ম মেনে কাজ করতে হবে।
মো. মাসুম কামাল ভূঁইয়া বলেন, ক্ষুদ্রঋণ বর্তমান বিশ্বের আলোচিত বিষয়। তৃতীয় বিশ্বের গরিব মানুষ এর ভোক্তা ও গ্রাহক। এর বড় অন্তরায় উচ্চ সুদহার। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন এ বিষয়টি তদারকির কোনো সংস্থা ছিল না। ২০০৬ সাল থেকে এ বিষয়ে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রয়েছে অভিযোগ কেন্দ্রও।
গভায় সভাপতিত্ব করেন মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাজহারুল হক।
ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমআরএ’র পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন আরো উন্নত করে দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে এনে ক্ষুদ্রঋণের সার্ভিস চার্জ আরো কমাতে হবে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন পূবালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম মিয়া, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রহমান সরকার, সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া, জনতা ব্যাংকের ডিএমডি মো. মোশারফ হোসেন চৌধুরী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম, ড. মো. মসিউদ্দিন সাদেক, ইনামুল হক চৌধুরী প্রমুখ।
সভায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক, উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), সুশীল সমাজ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ডিএফআইড’র প্রতিনিধি, এমআরএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘এমআরএ আইন ও বিধিমালা’ বিষয়ক একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, এমআরএ আয়োজিত এ সভার মূল লক্ষ্য হলো, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর অর্থায়নের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইল জেলায় প্রথম অঞ্চলভিত্তিক সভা হয়। পরে রাজশাহী ও খুলনায় একই ধরনের মতবিনিময় সভা হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির কর্মরত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক প্রতিনিধির সঙ্গে এমআরএ ’র এটি চতুর্থ অঞ্চলভিত্তিক সভা।