দেশেই এখন মোবাইল সেট উৎপাদন করা সম্ভব। এমনকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করাও সম্ভব। সেই সঙ্গে এ খাতে বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানও হতে পারে। সম্ভাবনাগুলোর বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন সরকারের নীতি সহায়তা।
মোবাইল ফোন সেট ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরে প্রায় ১ কোটি মোবাইল ফোন সেট আমদানি করা হয়। যার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অবৈধ পথেও বিপুল সংখ্যক মোবাইল সেট দেশে ঢুকছে।
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা আরো জানান, বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রতি বছর আমদানি করা হচ্ছে মোবাইল ফোনসেট ও খুচরা যন্ত্রাংশ। অথচ দেশেই মোবাইল ফোন সেট তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
চলতি বছরের মধ্যে আরো ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি নতুন ব্যবহারকারী এ তালিকায় যুক্ত হবেন, এমনটাই আশা মোবাইল ফোন অপারেটরদের। ফলে আগামী বছর দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটির বেশি। প্রতি বছর বিক্রি হয় প্রায় ১ কোটি সেট। কিন্তু তারপরও দেশে মোবাইল সেট তৈরির কারখানা গড়ে উঠছে না। বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী আগ্রহী হলেও সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে সফল হচ্ছেন না তারা। ফলে সেটের বিশাল মার্কেটের পুরোটাই আমদানি নির্ভর।
বিটিআরসি’র সূত্র মতে, গ্রাহকের দেশে প্রতি মাসে বৈধ ও অবৈধভাবে ৮ লাখ ৫০ হাজার মোবাইল ফোনসেট আসে। এর সিংহভাগ আসে চীন ও ভারত থেকে। তবে বৈধভাবে আসে ৫ লাখ ৬০ হাজার এবং অবৈধ চ্যানেলে আসে ২ লাখ ৯০ হাজার। বৈধ আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় ১২ শতাংশ।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ অভিযোগ করেন, ক্ষেত্র বিশেষে আমদানি করা সেটগুলো খুবই নিম্নমানের এবং বেশিদিন টেকে না।
তিনি বলেন, যেসব ফোনসেট আসছে, সেগুলোর অধিকাংশের আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) নম্বর থাকে না। ফলে মোবাইল ফোনের অবৈধ ব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ঢালাওভাবে মোবাইল ফোনসেট আমদানি করতে না দেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ করেন বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান।
ব্যাবসায়ীদের মতে, মোবাইল ফোনসেট ও যন্ত্রাংশ আমদানি খাতে বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ক্রমাগতভাবে চাপ বাড়ছে।
ব্যাবসায়ীরা জানান, মোবাইল সেটের চাহিদা বাড়ায় আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। এ অবস্থায় দেশে মোবাইল সেট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রণোদনা এবং বিনিয়োগের সুরক্ষার ব্যবস্থাও করতে হবে।
এ ব্যাপারে ওয়ালটনের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর উদয় হাকিম বলেন, ‘সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পলিসি সাপোর্ট পেলে আমরাও এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। প্রাথমিক প্রস্তুতিও আমাদের আছে। কিন্তু সবার আগে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশে তৈরি হলে দামও নেমে যাবে অর্ধেকে। তবে উৎপাদনের চেয়ে আমদানি বেশি লাভজনক হলে কে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন?’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘কয়েক বছর আগে সামসাং এদেশে মোবাইল ফোনসেট প্রস্তুতের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু অবাধ আমদানি ও চোরাই ফোনসেটের বাজার দেখে তারা পিছিয়ে গেছে।’
টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘দেশেই মোবাইল ফোনসেট নির্মাণ ও যন্ত্রাংশ তৈরির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। এ খাতে দেশে দক্ষতাসম্পন্ন কারিগরি ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ছাড়াও উদ্যোক্তার অভাব নেই। কিন্তু অবাধ আমদানি ও চোরাইপথে বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোন সেট আসার ফলে, এ খাতে ঝুঁকি নিতে কেউ আগ্রহী হচ্ছেন না।’
‘এছাড়া এ খাতের জন্য সরকারের নীতিমালাও শিল্পোদ্যোক্তাদের অনুকূলে নয়। গত কয়েক বছরে ওয়ালটনসহ বেশ কিছু আগ্রহী উদ্যোক্তা দেশেই মোবাইল ফোন সেট তৈরির সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করলেও অবাধ আমদানির ফলে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে যান।’
ওয়ালটনের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং বিভাগের প্রধান লোকমান হোসেন আকাশ বলেন, ‘পাশ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যেসব মোবাইল ফোনসেট দেদারসে দেশে আসছে, সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। অবাধ আমদানি ও চোরাই পথ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই প্রয়োজন।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, চীনে একটি সাধারণ মানের মোবাইল ফোনসেটের দাম ২৫ থেকে ৩০ ডলার। কিন্তু সেই সেটটি দেশে এনে বিক্রি করা হচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায়।