পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিশাল ছয় লেনের সড়ক চলে গেছে ইয়াঙ্গুন থেকে নিপিটো। এটি মায়ানমারের নতুন রাজধানী। নিপিটো গড়ে উঠছে আধুনিকতার সব কিছু নিশ্চিত করে।
এই শহরে যাওয়ার পথ ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটর ওয়ে। ২২০ মাইল দীর্ঘ সড়ক কিলোমিটারের হিসেবে ৩৫২ কিলোমিটার। এই সড়কের বর্ণনায় প্রথম যে কথাটি বলতে হবে তা হচ্ছে- এর ওপর একটিও স্পিড ব্রেকার নেই। আঁতকে ওঠার মতো কথাই বটে। কিন্তু এটাই সত্য।
১৪ সিটের যে গাড়িতে আমরা নিপিটো যাচ্ছিলাম তার চালক উ পোয়া বলতে গেলে পুরো পথটিই ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালিয়েছেন। পোয়া বললেন, এটাই এই সড়কের সাধারণ গতি। মাঝখানে দুটি স্থানে চোখে পড়লো গতি সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার ও সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটারের নির্দেশনা রয়েছে। বাকি পথে গাড়ি চলে একই গতিতে। ভ্রমণসঙ্গী একজনকে বললাম, মনে হচ্ছে যেনো স্পিডবোটে চড়ে কোথাও যাচ্ছি। চাকার নিচে রাস্তাটি পানির মতোই মসৃন।
পুরোটাই আরসিসি কংক্রিট ঢালাই। নেই পিচ, বিটুমিনের ব্যবহার। ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটরওয়ের ২২০ মাইলে কোনো ক্রস রোড নেই। নেই কোনো সিগন্যাল। দুটি টোল সেন্টার ছাড়া। তিনটি স্থানে নিচে দিয়ে রাস্তা নিয়ে এসে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মূল সড়কে। মিয়ানমারে গাড়ি চলে রাইটওয়ে ধরে। এতে কোনো বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় কি না তা জানতে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হবে। তবে মায়ানমারে উ পোয়া ছাড়াও তোরা, উন থান ও মিন তাবে নামের চার জন চালকের গাড়িতে চড়েছি গত চার দিনে। এদের মধ্যে থান ও তাবে ট্যাক্সি চালক। তাদের প্রত্যেকেরই মতে ডান দিক দিয়েই গাড়ি চালানো সুবিধাজনক। অবশ্য এ থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কারণ তাহলে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহরেই লেফট ওয়েতে গাড়ি চলে।
এখানে বলে নেওয়া ভালো, বেশ কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই মায়ানমারে রাস্তার ডান দিকে গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে বাম দিক দিয়েই গাড়ি চলতো। কিন্তু কোনো এক জ্যোতিষীর কথা মতো ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয় সরকার। তখন থেকেই সেভাবে চলছে। এখানে আরও আশ্চর্যের যে গাড়ির চালকদের অধিকাংশই গাড়ি চালাচ্ছেন লেফট সাইড সিটে বসে।
বিমানবন্দর থেকে নেমে গাড়ির সামনের সিটে বসে হঠাৎ করে ভড়কেই গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো চালক ভুল করছে। অথবা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ডান দিকে চলে গেছে। কিন্তু না দেখা গেলো সব গাড়িই ডান দিক দিয়ে যাচ্ছে। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ি বায়ের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে। এর পর ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় যখনই বের হয়েছি বার বারই মনে হয়েছে গাড়ি রং সাইড দিয়ে চলছে এবং এই বুঝি উল্টো দিক দিয়ে আসা কোনো গাড়ি এসে হামলে পড়বে মুখোমুখি। তেমনটা অবশ্য একবারও হয়নি।
ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটর ওয়ে প্রসঙ্গে ফিরে যাই। শুনেছিলাম রাস্তাটি পাহাড় কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু রাস্তাটিতে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম, এটি বানানো হয়েছে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে। কেবল মাত্র যেখানে না কেটে উপায় ছিলো না সেখানেই কাটা হয়েছে পাহাড়। দুই দিকের সড়কের মাঝখানে ৩০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত ডিভাইডার। যার মাঝখান দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ড্রেন। রাস্তায় এখন গাড়ি খুব কম। কিন্তু এক সময় বাড়বে। তাই বলে কখনোই তা গাড়ি চালকের দুর্ভোগের কারণ হবে না বলেই মনে করেন উ পোয়া। সারাক্ষণ পান চিবোচ্ছেন। মুখ ভর্তি পান নিয়ে কথা বলতে পারেন না। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেন, এই সড়কই মায়ানমারে আধুনিকতার প্রথম চিহ্ন। এর মধ্য দিয়েই আসবে উন্নয়ন।
একজন গাড়ি চালকের এই ভাবনায় অভিভূত হলাম। মনে পড়লো কমিউনিকেশনের প্রথম পাঠ নেওয়ার দিনটির কথা। প্রয়াত অধ্যাপক কিউ এ আই এম নুরুদ্দিন স্যার যোগাযোগ তত্ত্বের প্রথম ক্লাসেই অজ পাড়া গাঁর দুটি গ্রামের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছিলেন, পাশাপাটি দুটি গ্রামের মধ্যে একটি বর্ধিষ্ণু আরেকটি পিছিয়ে পড়া। এর কারণ বর্ধিষ্ণু গ্রামের সঙ্গে রয়েছে শহরের একটি সংযোগ সড়ক। অপর গ্রামটির সঙ্গে তা নেই। উ পোয়ার কথায় সে যোগাযোগ তত্ত্বের মিল খুঁজে পেলাম।
বিশাল অর্থ ব্যয়ে এমন একটি সড়ক কী অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে আসবে তা জানতে পাঠককে নিপিটো পর্যন্ত অবশ্যই নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার আগেই উ পোয়া দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন সড়কের পাশে সারি সারি সেগুন গাছের দিকে। সেগুন কাঠ বিশ্বের সবচেয়ে দামি কাঠগুলোর একটি। তার ওপর বার্মাটিকের রয়েছে আলাদা আভিজাত্য। দেখলাম প্রতি দুইগজ অন্তর একটি করে সেগুন গাছ লাগানো হয়েছে। কিছু দুর পরপরই পুরো সেগুনের বাগান।
সহযাত্রীদের একজন ডাগর হয়ে ওঠা সেগুনগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেবল এই সেগুন কাঠ থেকেই সড়ক নির্মাণের সব খরচ উঠে আসবে। সঠিক হিসেব জানা যায়নি। তবে গাড়িতে আমরা যারা এক সঙ্গে ছিলাম তাদের হিসেবে রাস্তার দুই ধারে ও মাঝের ডিভাইডার মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি সেগুন গাছের রোপণ রয়েছে। বার্মাটিক কাঠের দর সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারবেন। মাঝে মাঝে রাবার প্ল্যানটেশন ও ফলজ গাছ বিশেষ করে আম বাগানও চোখে পড়লো। যেসব জমিতে এই প্ল্যানটেশন তা এতদিন ছিলো স্রেফ জঙ্গল ও পতিত জমি। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটারের দেশ মায়ানমারের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের চেয়ে ছয় গুন বড় এই দেশটির জনসংখ্যা বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম।
উ পোয়ার কথাই মেনে নিতেই হলো নতুন মায়ানমারের উন্নয়নের প্রথম ধাপ এই ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটর ওয়ে। নিপিটোতে গিয়ে দেখলাম একটি নতুন শহর গড়ে উঠছে। দেশের প্রেসিডেন্ট হ্উাস, সংসদ ভবন এখন নিপিটোতে। সকল মন্ত্রণালয়, দেশের প্রধান ব্যাংক এরই মধ্যে নিপিটোতে তাদের অফিসভবন নির্মাণ করে কাজ শুরু করেছে। গড়ে উঠছে আধুনিক সব হোটেল, মার্কেট ইত্যাদি। সবগুলো দূতাবাসের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এখানেই। বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জমিতে শিগগিরই নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে বলে জানালেন মায়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিপিটো গিয়ে দূতাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দূতাবাসের জন্য এই জমি বিনে অর্থে বরাদ্দ দিয়েছে মায়ানমার সরকার।
ফিরে আসি সড়ক প্রসঙ্গেই। সড়কের দুই পাশে মাইলস্টোন বসানো হয়েছে। প্রতি এক মাইলকে ভাগ করা হয়েছে সাত ভাগে। মিনিটেই পার হয়ে যাওয়া যায় এক মাইলের বেশি। যেনো গতির আরেক নাম ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটরওয়ে। ছয় লেন রাস্তার দুই পাশেই আরও চারটি করে লেন তৈরি করে রাখা হয়েছে। ফিনিশিং দেওয়া হয়নি। প্রয়োজন মাফিক সে অংশকে চালু করা হবে। ইয়াঙ্গুনে থাকেন বাংলাদেশের মো. মাহমুদুর রহমান বকুল। বেসরকারি ব্যাংক এবি ব্যাংকের মায়ানমার প্রতিনিধি কার্যালয়ের প্রধান তিনি। জানালেন, তিন বছরের মধ্যে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করেছে মায়ানমার সরকার।
কত খরচ হয়েছে জানার চেষ্টা করেও জানা গেলো না। মায়ানমারে ব্যবসা করছেন এমন একজন বাংলাদেশি হাজি ইউনুস জানালেন, খরচ হয়েছে, যা লেগেছে তাই। কোনো সুনির্দিষ্ট বাজেট ছিলো না। আর সামরিক সরকার থাকায় শেষ পর্যন্ত কত খরচ হয়েছে তা জানানোও হয়নি।
খুব মনে পড়লো ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চার লেন বিশিষ্ট করতে সরকারের দীর্ঘ পরিকল্পনার কথা। সরকারের তিন বছর পার হয়ে গেলেও যা এখনো সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। বরং খোঁড়াখুঁড়ি, ভাঙ্গাভাঙ্গিতে বেড়েছে ধুলো আর দুর্ভোগ। মায়ানমারকে মনে হয়েছে একটি ধুলোহীন দেশ। সড়কগুলো ধুলো ও দুর্ভোগমুক্ত। টানা ৩৫২ কিলোমিটার জার্নি করেও মাথার চুলে জট পাকায়নি, আঠা আঠা হয়ে যায়নি, গন্তব্যে পৌঁছে কাশি থেকে বের হয়ে আসেনি ধুলোর দলা।
নিপিটো সড়কে যে দুর্ঘটনা ঘটে না তা নয়। তবে এ বিষয়ে একটি অভিনব উদ্যোগ লক্ষ্য করলাম। সহযাত্রীদের প্রায় সকলেই জানালেন বিশ্বের কোথাও তাদের এমনটি চোখে পড়েনি। তা হচ্ছে, প্রতিটি অ্যাক্সিডেন্ট সাইটে ওই অ্যাক্সিডেন্টে গাড়িটির কি বেহাল দশা হয়েছিলো সেই ছবি তুলে বড় বিলবোর্ড বানিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। উ পো বললেন, এমন একটি ছবি যে কোনো চালককে সতর্ক করবে। তবে এ রাস্তায় ব্রেক ফেইলড না হলে, গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি না হলে দুর্ঘটনা বিরল।
এক সময় এই পুরো এলাকা ছিলো দুর্গম, অজপাড়াগাঁ। এগুলো এখন বর্ধিষ্ণু হয়ে উঠছে। রাস্তার পাশে একটি গ্রামে গিয়ে ধীরে ধীরে উন্নয়নের ছোঁয়া লক্ষ করা গেলো। মোটর সাইকেল চেপে নারী-পুরুষ (নারীরাই বেশি) তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আশে পাশের বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। গ্রামে ঢোকার মুখেই দেখা গেলো পান-সুপারির পসরা সাজিয়ে বসে এক নারী দোকানি। মাহমুদুর রহমানের, যিনি ভাঙ্গাভাঙ্গা বার্মিজ ভাষা বলতে শিখেছেন, মাধ্যমে জানতে চাইলাম দোকান থেকে আয় কেমন। নামে বদু (নাম কি?) প্রশ্ন করে জানা গেলো উথু পা। এই নারী দোকানি জানালেন তার আয়েই সংসার চলে। রাস্তাটি নির্মাণের পরেই তিনি এই পান-সুপারির দোকান বসিয়েছেন। এভাবে ইয়াঙ্গুন-নিপিটো মোটর সড়ক জীবীকার সুযোগ করে দিয়েছে হাজার হাজার নারী-পুরুষের।
রাস্তার পাশে এই গ্রামগুলোতে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। তবে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে সোলার সিস্টেম। ফিশারিজ, পোল্ট্রি শিল্পও চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে ইয়াঙ্গুন- নিপিটো মোটর ওয়ে মায়ানমারের উন্নয়নের নতুন সোপান। অধুনা প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র আর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলা দেশটির প্রতি এখন বিশ্বের অনেক দেশেরই রয়েছে বিশেষ দৃষ্টি।