প্রস্তাবিত ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টায় বিজিএমইএ সম্মেলন কক্ষে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শফিউল ইসলাম এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘ঘোষিত বাজেট শিল্পবান্ধব হলেও তৈরি পোশাকের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে রপ্তানি ক্ষেত্রে উৎসে কর্তিত করের হার শূন্য দশমিক ৬০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ২০ ভাগ নির্ধারণ করা এ শিল্পের অন্তরায়।’
শফিউল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যক্ষ কর শতভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে যা শিল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি পোশাক শিল্পে বহাল রাখা হলে শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিতভাবেই ব্যহত হবে।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানিমুখী শিল্প ধারণাগতভাবে ১২ শতাংশ মুনাফা করে। যার ওপর দশ শতাংশ কর এবং ১ দশমিক ২০ শতাংশ উৎস কর কেটে নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে পোশাক শিল্প কারখানাগুলো প্রকৃত মুনাফা করে বিক্রয়মূল্যের শূন্য দশমিক ৫০ ভাগ থেকে ১ ভাগ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে সরকারে ঘোষিত সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে অধিকাংশ শিল্প মালিককে বাড়ি থেকে টাকা এনে কর দিতে হবে।’
এক্ষেত্রে কয়েকজন সফল ব্যক্তিকে উদাহরণ হিসেবে না রেখে সব রপ্তানিকারকের অবস্থা বিবেচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।
শুরুতে তিনি বলেন, Ôআমরা আনন্দিত যে- এবারের বাজেটে শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে কারখানার স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার উপর থেকে ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প বিশেষভাবে উপকৃত হবে|Õ
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, Ôরপ্তানিমুখী শিল্পে এসআরও এর আওতাধীন মুলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কহার ১ শতাংশের পরিবর্তে শূণ্য করা হয়েছে। এটা শিল্প বিকাশে সহায়ক। এয়াড়া ইটিপি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় কেমিক্যালস এর মধ্যে যেগুলো দেশে উৎপাদিত হয় না, সেগুলোর আমদানির ক্ষেত্রে ৩ শতাংশের অতিরিক্ত সব শুল্ক-কর মওকুফ করা হয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ১ শতাংশের পরিবর্তে শূণ্য শূল্ক সুবিধা প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা মনে করি, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের জন্য ইটিপি প্ল্যান্টের ব্যবহৃত ডাইস-কেমিক্যাল ইত্যাদির সম্পূর্ণ শূল্কমুক্ত আমদানি প্রয়োজন।Õ
তিনি বলেন, Ôঅর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ইটিপি স্থাপনে ২০০ কোটি টাকার তহবিল রাখা হয়েছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, বীমা, কুরিয়ার, ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। রপ্তানিখাত বহুমূখীকরণ ও রপ্তানি বাণিজ্যকে প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমরা এ সকল ব্যবসাবান্ধব প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানাই।Õ
তিনি বলেন, Ôআমরা গভীর উদ্বেগ ও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বাজেটে শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলেও শিল্পের পরিপন্থি পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। সব ধরনের রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎসে কর্তিত করের হার ০.৬০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১.২০ শতাংশ নির্ধারন করা হয়েছে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর শতভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে যা শিল্পের সাথে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি বিশেষ করে পোশাক শিল্পে বহাল রাখা হলে শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিতভাবেই ব্যাহত হবে।Õ
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, Ô১.২০ ভাগ উৎসে কর এর অর্থ হচ্ছে- রপ্তানীমুখী শিল্প ধারণাগতভাবে ১২ শতাংশ মুনাফা করে, যার উপর ১০ শতাংশ কর হিসেবে ১.২০ শতাংশ কর উৎসে কেটে নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে পোশাক শিল্প কারখানাগুলো প্রকৃত মুনাফা করে বিক্রয় মূল্যের ০.৫০ ভাগ থেকে ১.০০ শতাংশ।Õ
তিনি জানান, বিশ্বমন্দার বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের চাহিদা ক্রমশ কমে আসছে, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়েছে। চাহিদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মূল্য সংকোচন ও অপরদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ (মজুরি বৃদ্ধি ১০ শতাংশ, বিদ্যুৎ খরচ বৃদ্ধি ২৮ শতাংশ, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ১০ শতাংশ এবং ব্যাংক ইন্টারেস্ট ও চার্জ)। (এ সংক্রান্ত একটি ছক নিচে দেওয়া হলো)
Source Tax 0.6% Source Tax 0.7% Source Tax 0.8% Source Tax 0.9% Source Tax 0.10% Source Tax 0.11% Source Tax 0.12%
FOB $ 100 100 100 100 100 100 100
Raw Material $ 70 70 70 70 70 70 70
CM $ 28 28 28 28 28 28 28
Source Tax $ 0.6 0.7 0.8 0.9 1 1.1 1.2
Profit $ 1.4 1.3 1.2 1.1 1 0.9 0.8
তিনি বলেন, Ôএরূপ সিদ্ধান্ত রপ্তানীমুখী শিল্প ও বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে। পক্ষান্তরে তা নতুন বছরে অর্থনীতির ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ও সরকারের শ্রমঘন শিল্পায়ন কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, দেশে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির প্রায় ২৫ শতাংশ আসে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত থেকে, আর সেই খাতের সবচেয়ে বড় শিল্পের উপর এরূপ করের বোঝা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।Õ
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বছরে শুরুটি বেশ ভাল থাকলেও শেষ দুই মাসে (মার্চ ও এপ্রিল, ২০১২) রপ্তানি কমেছে পর্যায়ক্রমে ৬.৩৯ শতাংশ এবং ১১.৪০ শতাংশ। অর্থবছরের শেষ দুটি মাসে এই প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
সফিউল ইসলাম বলেন, Ôবস্তুতঃ ২০১২ সাল আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময় হয়ে থাকবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন বাজারে রপ্তানিতে যে গতি সঞ্চার হয়েছে তা ধরে রাখতে পারলে এই অভিঘাত কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তবে চলমান তিন বছর মেয়াদী প্রণোদনা এই জুন মাসে শেষ হয়ে যাবে, যা আরও অন্ততঃ ৩ বছর বহাল রাখার মাধ্যমে নতুন বাজার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব। এ লক্ষ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫ শতাংশ এবং পরবর্তী দুই অর্থবছরে ৪ শতাংশ ও ৩ শতাংশ হারে নতুন বাজার প্রণোদনার অনুরোধ করছি|Õ
তিনি বলেন, Ôবাজেটে রপ্তানি উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিকে প্রাধান্য দিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিকে বেগবান করার জন্য এ খাতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার ঘোষণা হয়েছে। আমরা মনে করি, ‘রপ্তানি উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিকে প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা জরুরি।Õ
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘১০ হাজার টাকা বেতনে একজন শ্রমিককে বিদেশে পাঠানোর চাইতে ৭-৮ হাজার টাকা বেতনে দেশীয় শিল্পে কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে একটি ইনডেপথ স্টাডি করা প্রয়োজন। কারণ, যেখানে আমাদের পোশাক শিল্পে ২৫ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে এবং এ শিল্পে কাজ করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর আগে দেশের প্রয়োজন মেটানোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে ও সেই অনুযায়ী কার্যক্রাম নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস নারী শ্রমিকসহ ৭৮ হাজার দরিদ্র ল্যাকটেটিং মা’দের জন্য ভাতা প্রদানের প্রস্তাবকে আমরা অভিনন্দন জানাই। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর কিছু মৌলিক অধিকার যেমন- নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর জন্য ফুড রেশনিং, ডরমিটরি স্থাপন, শিক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।’
তিনি জানান, ‘এবারের বাজেট প্রস্তাবনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং সার্বিক যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে যা বাজেটের একটি ইতিবাচক দিক। তবে এর সুষ্ঠ ও যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে এ সব খাতে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে পাকিস্তানের মত স্বাভাবিক মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আশু বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে শুধু পরিবেশের বিষয়টিকে এককভাবে প্রাধান্য না দিয়ে কিভাবে পরিবেশ ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে কয়লা উত্তোলন ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, সেই লক্ষে ত্বড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
সভাপতি বলেন, ‘পরিকল্পিত শিল্পায়নের লক্ষ্যে অনেক উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরে পরিবেশ বান্ধব কারখানা স্থাপন করলেও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগের অভাবে কারখানা চালু করতে পারছে না। এ সব কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত করা গেলে ঢাকা শহরকে যানজট ও দুষণের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে, পাশাপাশি এর মাধ্যমে কমপ¬ায়েন্সের শর্ত পূরণও সম্ভব হবে।’
তিনি জানান, বর্তমান সময়ে অর্থনীতিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো- বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কাঙ্খিত মাত্রায় ধরে রাখা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে রাজস্বনীতি, মূদ্রানীতিসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সব পরিকল্পনা ও নীতি কৌশলের মধ্যে সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করা দরকার। বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য সহনীয় সুদে ঋণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকের বর্তমান লাগামহীন উচ্চ সুদ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে থাকবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রধান অন্তরায়। সেই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতা দূর করতে পারলে কর্মদক্ষতা ও সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সংগঠনের সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, সিদ্দীকুর রহমান, এস এ মান্নান কচি ও পরিচালক শহিদুজ্জামান চয়ন, ফয়জুন্নবী চৌধুরী ও মশিউল আজম সজল উপস্থিত ছিলেন।