ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছেন, শ্রমিকনেতা আমিনুল হত্যাসহ নানা নেতিবাচক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ড হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। এ শিল্পে অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষ দ্রুত দূর করা না হলে প্রধান মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) কমপ্লেক্সে নির্বাহী পরিষদের সভায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা এসব কথা বলেন।
বিজিএমইএ সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সচিব গোলাম হোসেন, সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ড্যান মজিনার লিখিত বক্তব্য
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি কমে যাওয়ার অবস্থার কিছু কারণ আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই। আমিনুল ইসলাম হত্যা, তিনি একজন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ছিলেন এবং যুক্ত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সমর্থিত সলিডারিটি সেন্টার ঢাকার সঙ্গে। এটা এএফএল-সিআইও-এর (যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠন) সঙ্গে যুক্ত। যদিও এ হত্যা বাংলাদেশে খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক অধিকার সমর্থকরা এই ইস্যুটি নিয়ে আন্দোলন করছে। এটা বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে পর্যবসিত হচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেসের অনেক সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে এ ব্যাপারে তাদের আশংকার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। ক্লিনটন আমিনুলের নাম ধরে এ ইস্যুটি প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার কাছে তুলে ধরেন। হিলারি বাংলাদেশের শ্রম অবস্থা নিয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেন।’
এএফএল-সিআইও বাংলাদেশের জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) অধিকার বাতিলের জন্য আবেদন করেছে যা এখনও নির্ধারিত হয়নি। যদিও এর ফলে তৈরি পোশাকশিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে এ অধিকার বাতিল হলে এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে একটি নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে যাবে যে, বাংলাদেশ শ্রমবান্ধব নয়; এই বার্তাটি তৈরি পোশাক ক্রেতা ও ভোক্তার কাছেও পৌঁছে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সম্পাদনে দেরি হওয়াটা ওয়াশিংটনে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক শ্রম আইনগত বাধ্যবাধকতা থেকে পিছু হটছে, যা তারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন ঘোষণায় অঙ্গীকার করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার অঙ্গীকার থেকে পিছু হটতে পারবে না এবং হটবে না। টিকফা খুবই সরল ও এটিতে একটি মাত্র কার্যকরী বিষয় রয়েছে দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগের বাধা দূর করতে একটি ফোরাম গঠন।’
সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন অন্যতম ক্রেতা আমাকে মধ্যরাতে ফোন করেছিল তার আশংকার কথা জানাতে যে, বাংলাদেশের ব্র্যান্ড সংকট তার কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিনি তার আশংকা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সংবাদ মাধ্যমে বিশদ প্রতিবেদনের জন্য। তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত ছিলেন অন্য এক কারখানায় আগুন লাগার প্রভাবের কথা চিন্তা করে। তার উদ্বেগের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনের অভাবের কারণে কর্মস্থলের পরিবেশ খুবই খারাপ। কারণ সংগঠিত শ্রমিকরা খারাপ কর্মস্থলে কাজ করতে চায় না। আমি এর আগে কখনও এ ধরনের ফোন পাইনি। তিনি বলেন, তার কোম্পানি বাংলাদেশি পণ্যের জন্য বেশি দাম দিতে চান যদি সেখানে স্বচ্ছ বাণিজ্য হয়। এক কথায় তার কোম্পানির সুনাম প্রতিটি শার্টে কয়েক সেন্ট বাঁচানোর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
সম্প্রতি ঢাকায় এক নৈশভোজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ব্র্যান্ডের ছয়জন ক্রেতা আমাকে পাশে ডেকে নেন এবং তাদের প্রধান কার্যালয়ের থেকে পাওয়া উদ্বেগের বিষয়গুলো আমাকে জানান। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এবিসি নিউজসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্র্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়া তারা বাংলাদেশে উন্নয়নের নেতিবাচক ধারণার কারণে তাদের কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ব্যাপারে তাদের উদ্বেগের কথা জানান।
আমি নিশ্চিত যে আপনারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে সুইডিশ ফ্যাশন রিটেইলার হেনিস অ্যান্ড মরিৎজ (এইচঅ্যান্ডএম) সিনিয়র নেতাদের উদ্বেগ নিয়ে ‘ডো জোন্স নিউজওয়্যার’-এর প্রতিবেদনটি দেখেছেন। বিজিএমইএর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নিজেরাই আমার সঙ্গে এ বিষয়টি আলোচনা করেছেন যে, ক্রেতারা একই রকমের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এমনকি তাদের সফরও বাতিল করেছে।
তৈরি পোশাক খাতে শ্রম পর্যবেক্ষণকারী বাংলাদেশি কর্মীরা আমাকে বলেছেন যে প্রধানত জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় এবং আমিনুল ইসলামের মৃত্যু ও অন্যান্য শ্রমিকদের হয়রানির ফলে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে, এই হতাশা বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমনটি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়ায় ঘটেছে। এধরনের বিশৃংখলা বাংলাদেশি পরিচয়ে ক্রেতারা অস্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন।