আতংকের নগরী করাচি: ৫ মাসে নিহত ৭৪০

আতংকের নগরী করাচি: ৫ মাসে নিহত ৭৪০

সাম্প্রদায়িক, গোষ্ঠীগত কিংবা রাজনৈতিক কারণে নিয়মিতভাবেই বিশ্বমিডিয়ায় শিরোনাম হয় পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচি। কথায় কথায় এ শহরের গলিতে, রাজপথে চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সহিংসতায় লিপ্ত পক্ষগুলোর সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে মহড়া দেয় অনেকটা প্রকাশ্যেই।

অবস্থা এমন যে তাদের মোকাবেলায় বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার মানসিকতা নিয়ে দাঁড়াতে হয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের।

জনারণ্যে, করাচির প্রকাশ্য রাজপথে হঠাৎই শুরু হয়ে যায় গোলাগুলি। আতঙ্কিত লোকজনের ছোটাছুটিতে জনপদজুড়ে বয়ে যায় আতঙ্কের হিমশীতল প্রবাহ। শূন্য রাজপথে হয়তো পড়ে থাকে বোমায় ছিন্নভিন্ন, গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া আদম সন্তানের শব। আহতদের আর্তচিৎকারে হরর মুভির আবহ বিরাজ করতে থাকে দীর্ঘক্ষণ- যতক্ষণ না খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আর দমকল বাহিনী ছুটে আসে।

কিন্তু এসব ঘটনায় হতাহতদের বেশিরভাগেরই ঘটনার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু এসব ভাবার সময় আছে কার? কারণ দেশটা পাকিস্তান। মার্শাল ল’র দেশ হিসেবে পরিচিত এই দেশটিতে শবযাত্রা, বরযাত্রা, শোভাযাত্রা সবই সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষবস্তু হতে পারে যে কোনো সময়- অন্তত বাস্তবতা তাই বলে।

সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রিত এলাকারগুলির মুখগুলোতে দেখা যায় মুখ ঢাকা, হাতে মেশিনগান, এমনকি কখনও কখনও বিমানবিধ্বংসী কামান নিয়ে টহলরত সশস্ত্র ব্যক্তিদের। তাদের বিরুদ্ধে অসহায় হয়ে পড়ে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে অভিযানে নামতে হয় সাজোঁয়া যান নিয়ে। এসময় নিজের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় পুলিশকে।

পুলিশ মাঝে মাঝে ব্যাপক তোড়জোর চালিয়ে সন্ত্রাসী দমনে অপারেশনে নামে। কিন্ত সব উদ্যোগ প্রায় ক্ষেত্রেই অঙ্কুরেই বিনাশ হয়, কখনো মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়ে- রাজনৈতিক বা সামরিক চাপে।

একটি পরিসংখ্যানেই ধারণা করা সম্ভব নগরীর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।করাচিতে চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে শুধু গ্যাং-ফাইটেই মারা গেছেন ৭৪০ জন মানুষ। এদের  বেশিরভাগই নিরীহ, নিরপরাধ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।

একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে প্রায়ই নগরীর কোনো কোনো অংশ হয়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্র। ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর শহরতলীগুলো হয়ে উঠেছে সশস্ত্র আততায়ীদের নিরাপদ বিচরণভূমিতে। প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকার কারণে আইনশৃংখলা  রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছেনা তাদের নিয়ন্ত্রণ করা।

হিউম্যান রাইটস কমিশন অব পাকিস্তানের প্রধান জোহরা ইউসূফ বলেন, গত পাঁচমাসে বিবদমান সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলোর বন্দুকযুদ্ধের কবলে পড়ে ৭৪০ জন লোক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় গত বছরও করাচিতে সহিংসতায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ৭১৫ জন লোক।

প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত এ নগরী পাকিস্তানের অর্থনীতিরও প্রাণকেন্দ্র। তাই এ নগরীর যে কোনো সহিংসতা আর অস্থিরতার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় পুরো পাকিস্তানের অর্থনীতিই। সহিংসতার কারণে নগরীর কোনো না কোনো অংশ অচল হয়ে পড়া বর্তমানের একটি নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা।

নিত্যদিনের ব্যস্ত বাজারসমৃদ্ধ গলিপথগুলোতে হঠাৎই হয়ত শোনা যাবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজ। মুহূর্তেই শুরু হয়ে যাবে আতংকিত লোকজনের ছোটাছুটি। পেছনে পড়ে থাকবে কোনো হতভাগার মৃতদেহ। রাস্তায় নেমে আসবে মারাত্মক সব যুদ্ধাস্ত্র সজ্জিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা। এটাই এখন করাচির কোনো কোনো এলাকার নিয়মিত চিত্র।

পাকিস্তানের এ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র প্রায় প্রতিদিনই থমকে দাঁড়াচ্ছে সহিংসতার ঘটনায়। আর এ সব ঘটনার মাশুল দিচ্ছে নগরীর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরাই।

সহিংসতার কারণে নিরপরাধ মানুষ নির্বিচারে মারা যাচ্ছে উল্লেখ করে জোহরা ইউসুফ বলেন অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো বিচার না হওয়ার কারণেই উৎসাহিত হচ্ছে এসব অস্ত্রধারী। তিনি সরকারকে দোষারোপ করে বলেন পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুবই সামান্য।

এইচআরসিপির হিসেবে সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে মাত্র ১০৭ জন প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বাকিরা সবাই নিরপরাধ সাধারণ মানুষ, যাদের সঙ্গে নেই কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।

আন্তর্জাতিক