‘নিজে গুলি করে নূতন চন্দ্রের মৃত্যু নিশ্চিত করেন সাকা’

‘নিজে গুলি করে নূতন চন্দ্রের মৃত্যু নিশ্চিত করেন সাকা’

‘‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৩০ চৈত্র তারিখে কয়েকজন বাঙালি ও পাঞ্জাবি লোক এসে নূতন চন্দ্র সিংহকে মন্দির থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে গুলি (ব্রাশফায়ার) করে। পরে তাদের সঙ্গে থাকা সালাহউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী নূতন চন্দ্রের শরীরে আবার গুলি করে হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর সেখান থেকে বের হয়ে যান।“

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কাকা নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার এমনই বর্ণনা দিয়েছেন সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাতিজা গৌরাঙ্গ সিংহ।

মন্দিরের দোতলা থেকে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্রজহরির মুখে তিনি এসব কথা শুনেছেন বলেও ট্রাইব্যুনালকে জানান।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গৌরাঙ্গ সিংহ সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন।

সাক্ষ্যে গৌরাঙ্গ সিংহ বলেন, “আমার নাম গৌরাঙ্গ সিংহ, বয়স ৭৩ বছর,  কৃষিকাজ করি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স আনুমানিক বত্রিশ-তেত্রিশ বছর। ঘটনার দিন আমি বাড়িতে ছিলাম। আমার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যগহিরা গ্রামের কুণ্ডেশ্বরীতে।“

তিনি বলেন, “আমার বাবা দ্বারিকা মোহন সিংহ, কাকা নীলাম্বর সিংহ ও নূতন চন্দ্র সিংহের সঙ্গে একটি একান্নবতী পরিবারে আমাদের বসবাস ছিল। ১৯৭১ সালে আমি আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের সঙ্গে থাকতাম এবং তার সাংসারিক কাজকর্ম দেখাশোনা করতাম। আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের ঔষধালয় ছিল।“

তিনি আরো বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৩০ চৈত্র তারিখে আমি হিমাংশু বৈদ্য, বজ্রহরি কর্মকার, গোপাল দাস ও আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের সঙ্গে একত্রে বাড়িতে ছিলাম। আমরা নিরাপত্তার কথার ভেবে কাকাকে অন্যত্র নিয়ে যেতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে কোথাও যেতে রাজি হননি।“

গৌরাঙ্গ বলেন, “ঘটনার দিন ইংরেজি কত তারিখ ছিল তা আমার জানা নেই। সেদিন (৩০ চৈত্র) সকাল ৯টার দিকে আমি আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের সাথে কথা বলতে থাকা অবস্থায় আমাদের বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ি আসে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব, দেশীয় কয়েকজন লোকসহ বেশ কয়েকজন পাঞ্জাবি গাড়ি থেকে নামে। তাদের মধ্যে থেকে মাবুদকে চিনতে পারি।“

সাক্ষী বলেন, “এ সময় হিমাংশু বৈদ্য, মনোরঞ্জন সিংহসহ আমরা ৩ জন বাড়ির দক্ষিণে জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যাই। আর বাকি দুজন ব্রজহরি কর্মকার ও গোপাল দাস মন্দিরের দুই তলায় উঠে যান। তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ দেশীয় লোকজন ও পাঞ্জাবিরা আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের সঙ্গে কথা বলে চলে যান। জঙ্গলে পালিয়ে থাকায় অবস্থায় গাড়ির শব্দে বুঝলাম, তারা চলে গেলেন।“

গৌরাঙ্গ বলেন,“১০ থেকে ১৫ মিনিট পর গাড়ির শব্দে বুঝলাম, তারা ফিরে এসেছেন। তখন বোধ হয় স্টেনগান হবে, এমন গুলির শব্দ শুনলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার দু’ তিনটি গুলির শব্দ শুনলাম।“

“এ সময় আমরা আমাদের পালিয়ে থাকার স্থানকে নিরাপদ মনে করলাম না। পরে আমাদের বাড়ির পাশে এক মুসলিম বাড়িতে উঠি। সে বাড়ির আহমদ বশরকে আমার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহের খবর নিতে পাঠালাম। তিনি ফিরে এসে বললেন, নূতন চন্দ্র সিংহ রক্তাক্ত অবস্থায় মন্দিরের সামনে পড়ে আছেন।“

“এ খবর শুনে আমরা মন্দির থেকে একটি ত্রিপল এনে লাশ ঢেকে দিলাম। ওই সময় আমার সঙ্গে হিমাংশু বৈদ্য, মনোরঞ্জন সিংহ, ভাস্কর বড়ুয়া, আহমেদ বশর উপস্থিত ছিলেন। তখন কাকার বাম পাশে মুখে ও বুকের দিকে গুলির চিহ্ন দেখতে পাই।“

“এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে চলে যাই। পরের দিন রামগড় হয়ে ভারতে প্রবেশ করি।“

গৌরাঙ্গ তার সাক্ষ্যে আরো বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার  ১০ দিন পর ভারত থেকে ফিরে আসি। ভারত থেকে ফেরার সময় আমার সঙ্গে শুধু সত্যরঞ্জন সিংহ ও প্রফুল্ল সিংহ ছিলেন। দেশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে পরিবারের অন্য কেউ দেশে আসেননি। কারণ, তখন দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না।“

এ সময় গৌরাঙ্গ বলেন, “দেশে ফিরে এসে বজ্রহরির সঙ্গে দেখা হয়। তখন বজ্রহরি ১৯৭১ সালের তার দেখা দৃশ্যের বর্ণনা দেন। বজ্রহরি আমাকে বলেন, ঘটনার দিন ৩০ চৈত্র তারিখে সালাহউদিন কাদের চৌধুরী, দেশীয় কয়েকজন লোক ও পাঞ্জাবি বাহিনী এসে আমার কাকাকে মন্দির থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে গুলি (ব্রাশফায়ার) করেন। পরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও তাকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করেন। যে দৃশ্য মন্দিরের দোতলা থেকে তারা দু’জনই দেখেছিলেন।“

গৌরাঙ্গ জানান, “গুলি করে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার পরে প্রায় তিন দিন লাশ ওই স্থানে মন্দিরে সামনে পড়েছিল। পরে এলাকার চেয়ারম্যান আমানত খাঁ  পাড়ার অন্য লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে এসে কাকার লাশের সৎকার করেন।“

“স্বাধীনতার পরে পরিবারের সব সদস্য দেশে ফিরে এলে সত্যরঞ্জন বাবু কাকা হত্যার বিষয়ে একটি মামলা করেন। সেই মামলার খবর এখন আমি আর বলতে পারবো না।“

সাক্ষী বলেন, “আমি আমার সাক্ষ্যে যাদের নাম বলেছি, তাদের মধ্যে প্রফুল্ল ছাড়া আর কেউ জীবিত নেই। আমি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ রকম জবানবন্দীই এর আগে দিয়েছি।“

এ সময় গৌরাঙ্গ সাকা চৌধুরীকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, “আমি যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যে ও  জবানবন্দীতে বলেছি, তিনি আজ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আছেন।“

সাক্ষী গৌরাঙ্গ সিংহের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করেন। এদিন সাক্ষীক জেরা করবেন সাকা চৌধুরীর আইনজীবী।

উল্লেখ্য, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর এ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ ও সিরাজুল ইসলাম সিরু বাঙালি সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন আসামিপক্ষ। এর আগে ৩ মে ও ৭ মে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটম্যান) উপস্থাপন সম্পন্ন করে।

২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর মামলায় সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায়ই সে বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রত্যুষে গ্রেফতার করা হয় তাকে। এর আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে গ্রেফতারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে তদন্ত সংস্থা।

১৯ ডিসেম্বর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। পরে ৩০ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে প্রথমবারের মতো সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত দল। একই বছরের ১৪ নভেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ১৮ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

৫৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি ট্রাইব্যুনালে জমা দেয় প্রসিকিউশন।

এ বছরের ৪ এপ্রিল সাকার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এতে তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩টি মানবতাবিরোধী অপরাধের উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ করে গুডস হিলে নির্যাতন, দেশান্তরে বাধ্য করা, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধ।

বাংলাদেশ