ভারতের ছত্তিশগড়ে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় সাড়ে সাত বছর আগে ১৭ জন আদিবাসীর নিহত হওয়ার এক ঘটনায় নিরাপত্তাবাহিনী সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়েছিল বলে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তে উঠে এসেছে।
সারকেগুডা গ্রামের ওই ঘটনাটিকে এনকাউন্টার বা সংঘর্ষের ঘটনা বলে সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে তদন্ত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, যদিও বাস্তবে গ্রামবাসীদের দিক থেকে সেদিন কোনও প্রতিরোধই ছিল না।
ভারতের মানবাধিকার আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, এই প্রথম ভারতের কোনও সরকারি তদন্ত কমিশন মাওবাদী এলাকায় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে আঙুল তোলার সাহস দেখাল।
যদিও সেদেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমই এই রিপোর্ট নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব।
ভারতে মাওবাদী বিদ্রোহীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত বস্তারের বিজাপুর জেলার একটি গ্রাম সারকেগুডাতে ২০১২ সালের জুন মাসে ১৭ জন আদিবাসী নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছটি শিশুও ছিল।
সেই ঘটনার রেশ দিল্লিতেও পৌঁছায়, যার জেরে বিচারপতি ভি কে আগরওয়ালের নেতৃত্বে বসানো হয় একটি তদন্ত কমিশন।
সেই কমিশনের রিপোর্ট সদ্যই ছত্তিশগড় সরকারের কাছে জমা পড়েছে – আর রিপোর্টের বিষয়বস্তু সরাসরি হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত করেছে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সিআরপিএফ ও রাজ্য পুলিশকে।
বস্তারের বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সিপিআই দলের নেতা মনীশ কুঞ্জম ওই রিপোর্টটি দেখেছেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘কমিশন কিন্তু মেনে নিয়েছে যে ওই নিরীহ আদিবাসীরা সন্ধেবেলায় গ্রামের মাঝখানে একসঙ্গে বসে গ্রামেরই নানা বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছিলেন, তখনই তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়।’
‘এই রিপোর্টের বিশেষত্ব হল, আমি এত বছর ধরে এই অঞ্চলে রাজনীতি করছি – এই প্রথম দেখলাম কোনও তদন্ত রিপোর্টের রায় গ্রামবাসীদের পক্ষে গেল, আসল সত্যিটা কী ঘটেছে সেটা তুলে ধরা হল।’
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে ওই গ্রামবাসীরা যে মাওবাদী ছিল তার কোনও প্রমাণ মেলেনি, আর তাদের গুলিও চালানো হয়েছিল খুব কাছ থেকে – সম্ভবত একেবারে ঠান্ডা মাথায়।
তবে ঘটনা হচ্ছে, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ছাড়া ভারতের প্রথম সারির কোনও সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলই এই তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেনি।
‘জগদলপুর লিগাল এইড’ সংস্থার হয়ে বহুদিন ধরে বস্তারে নির্যাতিত মানুষদের আইনি সহায়তা দিয়ে আসছেন শালিনী গেরা।
তিনিও মনে করছেন মাওবাদী এলাকায় গ্রামবাসীদের একযোগে শাস্তি দেওয়ার যে নীতি নিরাপত্তা বাহিনী অনুসরণ করে, বিজাপুরের অভিযানও ছিল তারই অংশ।
শালিনী গেরা বলছিলেন, ‘বিজাপুরে গিয়েও সরেজমিনে আমরা দেখেছি এবং বুঝেছি এই ধরনের ঘটনা কোনও একজন বা দুজন পুলিশ কর্মকর্তার হঠাৎ মাথা থেকে বেরোল আর অভিযানে বেরিয়ে পড়া হল, ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়।’
‘এর পেছনে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, আশেপাশের গ্রামগুলোতেও ভয় বা আতঙ্ক তৈরি করার উদ্দেশ্য থাকে।’
‘সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা থাকে – যে মাওবাদীদের সঙ্গে ভিড়লে তাদেরও এই ধরনের পরিণতিই হবে, তাদেরও সমষ্টিগতভাবেই এরকম শাস্তি পেতে হবে।’
ভারতে মাওবাদী-বিরোধী অভিযানে বহু বছর ধরে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন বিএসএফের সাবেক প্রধান প্রকাশ সিং।
ভারতে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কারের কান্ডারী হিসেবে পরিচিত, সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভারতের কোনও নিরাপত্তা বাহিনী এ দেশের নাগরিকদের ওপর ইচ্ছে করে গুলি চালিয়েছে এ কথা তিনি বিশ্বাস করেন না।
তবে তিনি স্বীকার করছেন, ‘মাওবাদী দমনে যে ডকট্রিন গৃহীত হয়, সেই থিওরির সঙ্গে বাস্তবে তার প্রয়োগে অবশ্য অনেক সময়ই ফারাক থেকে যায়।’
প্রকাশ সিংয়ের কথায়, ‘এটা নির্ভর করে সেই সময় বাহিনীর নেতৃত্বে কে বা কারা আছেন, বাহিনীকে কী ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি নানা ফ্যাক্টরের ওপর।কিন্তু সাধারণত তারা কখনওই নিজেদের দেশের লোকের ওপর এভাবে গুলি চালাবে না, যদি না গোয়েন্দা তথ্যে গলদ থাকে।’
‘বিজাপুরে ঠিক কোথায় গন্ডগোল ছিল আমি জানি না, কিন্তু এটুকু জানি আমাদের ফোর্স মোটেই ট্রিগার হ্যাপি নয়, বরং তারা বিশ্বের বহু দেশের বাহিনীর চেয়ে অনেক সংযত। আমেরিকার নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তো অনেক ভাল, যারা সব সময় এধরনের ক্ষেত্রে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলে আড়াল খোঁজে!’
সারকেগুডার হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কমিশন অবশ্য দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে কোনও সুপারিশ করেনি।
কিন্তু মানবাধিকার আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরা চাইছেন এই রিপোর্ট হিমঘরে চালান না-করে যেন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা