`মন্ত্রী-এমপিদের কোনো নীতি নেই“- বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এমন একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রোববার হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জাতীয় সংসদ।
এমন মন্তব্যের জন্য তাকে সংসদে এসে ১৬ কোটি মানুষের কাছে শর্তহীন ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলেছেন স্পিকারের চেয়ারে থাকা প্যানেল চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী আশরাফ। পাশাপাশি তিনি গণতন্ত্র ও সংসদকে রক্ষা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মান রক্ষার জন্য একটি নিন্দা প্রস্তাব আনারও দাবি জানিয়েছেন।
শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও ইয়ুথ অ্যানগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্টার (ইয়েস) জাতীয় সম্মেলনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, “দেশের মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না, তারা নীতি মানেন না। শপথ নেওয়ার সময় বলেন অন্যায় করবেন না, কিন্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে তারা অন্যায় করেন। এসব মন্ত্রী-এমপির কোনো নীতি নেই।”
তিনি আরো বলেন, “একটা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্ত দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে জনগণের সম্পদ ও জীবন লুণ্ঠন করা হচ্ছে। মানুষ তার অধিকার হারাচ্ছে।”
রোববার প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মন্তব্যের বিষয়টি সংসদের দৃষ্টিগোচর করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম। এরপর এ নিয়ে একে একে কথা বলেন জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু ও আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
মোহাম্মদ ফজলুল আজিম বলেন, “টিআইবির আলোচনাসভায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রেখেছেন। এতে সংসদ সদস্যদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তার এই বক্তব্য সার্বভৌমত্বের লংঘন। তার কাছে এটা কাম্য নয়। আমরা যারা সংসদে আসি, তারা জনগণের রায় নিয়ে আসি। এখানে অনেকেই আছি, যারা বার বার নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসি।”
তিনি বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সমালোচনার উর্ধ্বে নন। সমালোচনা করুন। কিন্তু ঢালাওভাবে সংসদ সদস্যদের হেয় করা সংবিধান ও সংসদ অবমাননার শামিল। আমাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আমরা যদি নির্বাচিত হয়ে বেআইনি কাজ করি, তাহলে আগামী নির্বাচনে জনগণ আমাদের প্রত্যাখান করবে। অতীতে এর বহু রেকর্ড আছে।”
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “উনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। উনাকে সম্মান করি। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য মোটেই কাম্য নয়। এজন্য গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
পরে মুজিবুর রহমান চুন্নু বলেন, “অধ্যাপক আবু সায়ীদ শনিবার টিআইবির একটি অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইতিহাস হলো- দেশের জন্য, মানুষের জন্য যত বড় বড় কাজ, সব রাজনীতিবিদরাই করেছেন। এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতিবিদরাই সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ করেছেন।”
তিনি বলেন, “যিনি দেশের জন্য কিছু করতে পারেন না, দেশের মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেন না, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকে ভালো আছেন আবার খারাপও আছেন। কিন্তু উনার এ ধরনের ঢালাও মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি।”
পরে শেখ সেলিম বলেন, “অধ্যাপক আবু সায়ীদ একজন শিক্ষক। ওই শিক্ষক যদি ছাত্রদের এভাবে পড়ান, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে বলতে পারছি না। তার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানবে। সংসদের ওপর আঘাত এনেছে। এইসব বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু সময় জাতির বিবেক হয়ে যায়। কিন্তু জাতির দুর্যোগের সময় উনাদের টিকিও খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশে যখন গণতান্ত্রিক সরকার থাকে, জনগণের প্রতিনিধি থাকে, তখন এসব বুদ্ধিজীবীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সামরিক সরকার আসে, অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার আসে, তাহলে উনারা পদ পান। সুবিধা পান। টাকার মালিক হন। এদের চালচলন, জীবনযাত্রা, গাড়ি-বাড়ির টাকার উৎস কোথায়? একজন শিক্ষকের তো এতো গাড়ি-বাড়ি থাকার কথা না। সব টাকার উৎস সম্পর্কে তাদেরও জবাব দিতে হবে।”
তিনি বলেন, “টিআইবি প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়েও ঢালাওভাবে মন্তব্য করেছে। ১/১১ এর সময়ের দুর্নীতির কথা তো আপনারা বলেন নাই। আপনারা সার্টিফিকেট দেওয়া বন্ধ করেন। এনজিও থেকে টাকা আনেন এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। আর সেই টাকা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করেন।”
তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রীকে বলবো, তাদের সেই টাকার উৎস খুঁজে বের করুন। তাদের জবাব দিতে হবে। আমরা সংসদ সদস্য, সংসদে জবাব দেবো।”
তিনি আরো বলেন, “তারা সংসদের ওপর আঘাত হেনেছে। সংসদ ভালোভাবে চলুক এটা তারা চায় না। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি দেখান। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮০ সালে আমি যখন এমপি ছিলাম, তখন একজন পুলিশ অফিসার মন্ত্রী সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিল। স্পিকার তাকে সংসদের ডেকে এনে ডকে দাঁড় করিয়েছিলেন। ওই পুলিশ অফিসার নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছিল। এ নজির আমাদের সংসদে আছে। সুতরাং বিশেষ অধিকার কমিটিতে তাকে ডাকুন। তাকে ডেকে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তথ্যভিত্তিক সদুত্তর দিতে না পারলে গণতন্ত্র, জাতীয় সংসদ এবং এদেশের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মান রক্ষার জন্য তার বিরুদ্ধে সংসদ থেকে নিন্দা প্রস্তাব আনতে পারেন।”
এ সময় স্পিকারের দায়িত্বপালনকারী সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, “জনগণ এদেশের মালিক। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হতে হয়। এদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংসদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন- এমপি মন্ত্রীরা চোর-ডাকাতের মতো আচরণ করে। তাদের আচরণ সঠিক নয়। তারা শপথ ভঙ্গ করেন। তার এ ধরনের মন্তব্য সংবিধানের লংঘন। সংসদকে অবমাননা করা। একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রকে পদদলিত করেছেন। সংসদকে অবমাননা করা মানে গণতন্ত্রকে পদদলিত করার অপপ্রয়াস। এটা জাতির জন্য ভালো নয়। আমি মনে করি, সংসদ থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তার এ বক্তব্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমান সরকার নির্বাচিত। এটা সংবিধানের বাইরের কোনো সরকার নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সংসদ ছাড়া দেশের এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিতিহা থাকে না।”
তিনি বলেন, “তার বক্তব্যে সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। আমরা তাকে একটা নোটিস দিয়ে সংসদে তলব করতে পারি। তিনি যেই হোন না কেন সার্বভৌম সংসদ অবমাননাকারীকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। সংসদ সদস্যদের অবমাননা করা মানে জাতিকে অবমাননা করা। মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা।”
আলী আশরাফ আরো বলেন, “তাকে সংসদে দাঁড়িয়ে ১৬ কোটি মানুষের কাছে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এই সংসদ ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানেই জাতির ভাগ্য নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ জনগণকে এভাবে পদদলিত করা খারাপ সংকেত। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে।”
তিনি কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিশেষ অধিকার রক্ষা কমিটিতে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।