বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি রয়েছে ৬১ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে তিন হাজার ৮৪১ একর জমি দখলবাজরা দখল করে নিয়েছে। আর গায়েব করা হয়েছে এক হাজার ৮৪১ একর জমির নথি। দখল হওয়া এসব জমির মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম রেলওয়েতে ১০ বছরের চেষ্টায় ১১৮৫ একর উদ্ধার করা হলেও আবার দখল হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত রেলের ১৩ হাজার একর জমি ইজারা নেন ক্ষমতাসীন দলগুলোর নেতাকর্মীরা। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দখল হওয়া জমি উদ্ধারে বাংলাদেশ রেলওয়ে গত আগস্ট থেকে নতুন করে অভিযান শুরু করেছে। তবে প্রভাবশালীদের বাধার মুখে এই অভিযান বিভিন্ন স্থানে বন্ধ হয়ে পড়ার পথে।
এদিকে জমি ইজারা বিষয়ে নীতিমালা সংশোধন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই নীতিমালার খসড়া এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে।
রেলপথের দুই পাশে ১০ ফুট জায়গা খালি রাখার বিধান রয়েছে। রেল আইন অনুযায়ী, রেলপথের দুই পাশের দুই ফুট জায়গায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকার কথা। অথচ ঢাকার কমলাপুর থেকে টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ রেলপথের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা, অস্থায়ী বাজার। রেলওয়ে সূত্র জানায়, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে রেলের ৯২২ একর জমি। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে দুই হাজার ৮২৮ একর জমি। আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে দখল করা হয়েছে রেলের ৯০ একর জমি। ইজারায় ব্যবহৃত হচ্ছে ১৪ হাজার ৪৭৩ একর জমি।
রেলওয়ের সব জমি আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আনতে ২০০৭ সালে জরিপের কাজ দেওয়া হয় শেলটেক কনসালট্যান্ট লিমিটেডকে। ২০১৪ সালে তারা রেলওয়েকে জরিপের প্রতিবেদন জমা দেয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের নথিপত্রে ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমি থাকলেও শেলটেকের জরিপে পাওয়া গেছে ৫৯ হাজার ৭৫৫ একর জমি। এক হাজার ৮৪১ একর জমির দলিল বা আনুষঙ্গিক নথিপত্র পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ রেলওয়ে এখন আবার নতুন করে জরিপের জন্য নতুন পরামর্শক খুঁজছে।
সূত্র জানায়, দখলবাজরা রেলের এক হাজার ৮৪১ একর জমির দলিল, পর্চা ও নথি গায়েব করে দিয়েছে। আর এই নথি গায়েব কাণ্ডে জড়িত বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ, রেল ভবন থেকে শুরু করে পূর্ব ও পশ্চিম রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আর এই সুযোগে কৌশলে দখলবাজরা নিজেদের নামে রেলওয়ের এসব জমি রেকর্ড করে নিয়েছেন।
আবার দেখা গেছে, কৃষিকাজের জন্য রেলওয়ের ইজারা দেওয়া জমি ব্যবহৃত হচ্ছে বাণিজ্যিক কাজে। এসব জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন। রেল ভবন সূত্রে জানা যায়, এসংক্রান্ত হাজারো মামলা রয়েছে। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের তিন দশমিক ৯৭ একর জমি দখল হওয়ার চার দশকেও তা উদ্ধার করা যাচ্ছে না মামলার কারণে। তিনটি মামলার মধ্যে একটি মামলার রায় রেলের পক্ষে এসেছে। অন্য দুটি মামলা চলমান।
জানা গেছে, ওই জমিতে রেলের আইকনিক ভবন নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে রাজধানীর আনন্দবাজারে রেলের ২.৮৭ একর জমি দখলে নিয়ে সাত তলা ভবন নির্মাণ করে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ওই জায়গা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।
তথ্যানুসারে, রেলের পাকশী বিভাগে সর্বাধিক জমি দখল করেছেন দখলবাজরা। এ বিভাগে ২৭ হাজার একর জমির মধ্যে দখল করা হয়েছে দুই হাজার ৬০০ একর জমি। ঢাকা বিভাগে ১৭ হাজার ১৬৯ একর জমির মধ্যে তিন হাজার ৩৯৩ একর ইজারাদারদের দেওয়া হয়েছে। আর এ বিভাগে দখল হয়েছে ৬৮৪ একর জমি। লালমনিরহাট বিভাগে ১০ হাজার ৮৯৮ একর জমির মধ্যে দখল হয়েছে ৫১৮ একর জমি। চট্টগ্রাম বিভাগের সাত হাজার ২৭১ একর জমির মধ্যে দখল হয়েছে ১৬৯ একর জমি।
মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংস্থাও দখল করেছে রেলের জমি
রেলওয়ে সূত্র জানায়, নরসিংদী-মদনগঞ্জ সেকশনে ২২৫ দশমিক ৫৪ একর এবং হবিগঞ্জ জেলায় ১৬ দশমিক ছয় একর জমি অবৈধভাবে দখল নিয়েছে সওজ অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দখল নিয়েছে রেলের ১৩৩ একর জমি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ছয় একর, বন বিভাগ পাঁচ দশমিক ১৬ একর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দুই দশমিক ছয় একর, খাদ্য বিভাগ দুই একর জমি দখল করেছে।
ঢাকা বিভাগে গণপূর্ত বিভাগ (ঢাকা জেলা) এক একর, নারায়ণগঞ্জের আইইটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় দুই দশমিক ৩৮ একর, দ্বিতীয় পশুসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ছয় দশমিক ২৭ একর, ফায়ার সার্ভিস এক দশমিক এক একর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ছয় দশমিক সাত একর, পাট করপোরেশন (নারায়ণগঞ্জ জেলা) ১২ দশমিক ৫৪ একর, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক দশমিক ৯৪ একর জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। ঢাকা ওয়াসা দশমিক ২৯ একর, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগ ১০ দশমিক ৩৬ একর, গণপূর্ত বিভাগ ১৩ একর, সিলেটে খাদ্য মন্ত্রণালয় এক দশমিক সাত একর, মৌলভীবাজারে খাদ্য মন্ত্রণালয় এক দশমিক শূন্য তিন একর, আশুগঞ্জ ওয়াপদা ২৪ একর জমি দখল করেছে।
পশ্চিম রেলের নির্বাহী হাকিম ও পাকশী রেল বিভাগের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো: নুরুজ্জামান জানান, পাকশী বিভাগে রেলের সর্বাধিক জমি দখল হয়েছে সৈয়দপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী ও পার্বতীপুরে। এসব এলাকায় দখলকারী ১১ হাজার। ১৭টি অভিযানে এক হাজার ৮০০ একর জমির ওপর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। জমি উদ্ধার করা হয়েছে ১৪৫ একর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, মনে হচ্ছে সৈয়দপুর, পাবর্তীপুরে যেন রেলের জমি দখলদারদের লিখে দেওয়া হয়েছে। আমরা অচিরেই সৈয়দপুরে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডাবল লাইন প্রকল্পের জন্য গত বুধবার নারায়ণগঞ্জ রেলপথে ৯০০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। রেলওয়ের বিভাগীয় ভূমি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে রেলের আরো জমি অবৈধ দখলে আছে।’ গত বৃহস্পতিবারও অভিযান হয়েছে।
নাটোরের মাধনগর রেলস্টেশন বাজার এলাকায় সেখানকার সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো: মতিউর রহমান রেলের জলাশয় ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ করছেন। পাঁচ তলা ফাউন্ডেশনের মার্কেট ভবনটির এক তলা নির্মাণ শেষ। এখন সেখানে ব্যানার টাঙিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে পজেশন বিক্রি চলছে।
পশ্চিম রেলের নির্বাহী হাকিম মো: নুরুজ্জামান জানান, দ্রুতই সেখানে অভিযান চালিয়ে পুরো ভবন ভেঙে নিলামে ওঠানো হবে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, চট্টগ্রামে আইনি জটিলতায় ফয়’স লেকের প্রায় ৩৩৭ একর জমি দখলে নেওয়া যাচ্ছে না। রেলের ওই জমি ইজারা দেওয়ার পর শর্ত ভঙ্গ করায় কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্ট কম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার বিশ্বজিত ঘোষসহ একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি নিয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রূপপুর মোড়, ঈশ্বরদী জংশন, ঈশ্বরদীর নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল, পাকশী রেল বিভাগের সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে রেলের ২০০ একর জমি প্রয়োজন। অথচ এ পর্যন্ত দখলমুক্ত করা গেছে ৬০ একর জমি। এর মধ্যে ঈশ্বরদী রেল জংশন এলাকায় উদ্ধার করা হয়েছে ১৭ একর জমি।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রেলের জমি উদ্ধারে যেকোনো মূল্যে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। কারণ, বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না রেলের জমি দখল হয়ে যাওয়ায়। এবার এসব জমি উদ্ধার করা হবেই। দখলমুক্ত করা হবেই।’